ভ্যালেন্টাইন্স উইকের ৭টি দিন


শফিকুল ইসলাম
ভ্যালেন্টাইন্স উইকের ৭টি দিন
  • Font increase
  • Font Decrease

পাতা ঝরার মর্মর শব্দ আর রুক্ষ শীতের অবসান ঘটিয়ে আনন্দ বার্তা নিয়ে প্রায় উপস্থিত ঋতুরাজ বসন্ত। ফুলের সৌরভ আর অপরূপ রূপ প্রেমিক মনকে করে তোলে উদাসী। এই উদাসী মনকে প্রশান্তি দিতে মধুর কণ্ঠে অবিরাম গান শোনায় কোকিল। আর এই ভাষা ও ভালোবাসার মাসের মাঝামাঝি সময়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চলে যায় একটা সপ্তাহ, যাকে আমরা বলি ‘ভ্যালেন্টাইন্স উইক’। ভ্যালেনটাইনস উইক নিয়ে আমাদের বিশেষ প্রতিবেদন প্রকৌশল নিউজের পাঠকদের জন্য

৭ ফেব্রুয়ারি :হ্যাপি রোজ ডে

কাঁটাবন কিংবা শাহবাগের ফুলের দোকানগুলোর সামনে দিয়ে একবার হেঁটে গেলে আমাদের সবারই ইচ্ছে করে একটি লাল গোলাপ কিনে ‘তাকে’ উপহার দিতে। ভালোবাসার প্রতীকই যেন লাল গোলাপ। ভালোবাসার এই প্রতীকটির দিবস আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম নামকরণ করেন ডেনমার্কের রানি আলেকজান্দ্রা। ৫০তম বিবাহবার্ষিকীতে আলেকজান্দ্রা লন্ডনে আসলে লন্ডনের অধিবাসীরা তাকে হাজার হাজার লাল গোলাপ দিয়ে অভ্যর্থনা জানান। আলেকজান্দ্রা এত গোলাপ দেখে তো হতবাক! তিনি এক সিদ্ধান্ত নিলেন, এই হাজারখানেক গোলাপ বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে দরিদ্র, অসুস্থ মানুষদের প্রতি সেবার, ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দিতে বললেন। লাল গোলাপ দিয়ে ‘তার’ মুখে হাসি ফোটানোর জন্য পালিত হয় বিশেষ রোজ ডে। 

দিনটি চলে গেছে। তাতে কি আরো কয়েকটা দিন এখনো বাকি ভ্যালেন্টাইন্স উইকের। 

৮ ফেব্রুয়ারি :হ্যাপি প্রপোস ডে

একসঙ্গে তো কয়েকটি বছর কাটালেন, কিন্তু এখনো বুঝে উঠতে পারছেন না আপনার প্রিয় মানবীটিকে কীভাবে প্রস্তাব করবেন? তাহলে এই দিনটিতে আপনার না বলা কথাটাই বলে দিন হাতে এক গুচ্ছ গোলাপ নিয়ে, নতুবা আপনার অবস্থাটাও হতে পারে ঠিক জন মাইকেলের পিসতুতো ভাইয়ের মতো। মাইকেলের ভাইটি অনেক বছর অপেক্ষা সত্ত্বেও তার প্রেমিকাকে প্রস্তাব করতে পারেননি, ভাইয়ের এ হাল দেখে মাইকেল এই দিনটিকে উত্সর্গ করলেন প্রতিটি পুরুষের জন্য যাতে না বলা কথাটা এবারে প্রকাশ পায়।

আপনার কাঙ্খিত নারী বা পুরুষ বন্ধুটিকে সারাজীবন নিজের করে নিতে বা ভালোবাসার সম্পর্কটাকে আরো গাড় করতে এর থেকে ভালো উপলক্ষ আর কি হতে পারে?

৯ ফেব্রুয়ারি :হ্যাপি চকলেট ডে

একগুচ্ছ গোলাপের সাথে ভ্যালেন্টাইন সপ্তাহের তৃতীয় দিনটি ইউরোপ আমেরিকায় উদযাপিত হয় এক বাক্স চকলেট নিয়ে। সেই প্রাচীনকাল থেকে চকলেট উপহারের মাধ্যমে পছন্দের মানুষটির কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে বার্তাটি। চকলেটে এক ধরনের অ্যান্টিঅক্সিডেন্টস রয়েছে, যা উদ্দীপক, দুশ্চিন্তা নিরোধকের কাজ করে। কাছের মানুষটির দুশ্চিন্তা নিরোধের জন্য আপনিও এক বাক্স চকলেট উপহার দিতে পারেন।

দিয়ে দেখুন না এক বক্স বা একটি চকলেট। সামর্থ্য অনুযায়ী নিশ্চয় আপনার সঙ্গী বা সঙ্গীনি বিষটিকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখবে। 

১০ ফেব্রুয়ারি :হ্যাপি টেডি ডে

সর্বপ্রথম আমেরিকার মরিস মিচটম প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্টকে উত্সর্গ করে টেডি বিয়ার বাজারজাত করেন। স্বাভাবিকভাবেই অল্প দিনেই বাচ্চাদের মাঝে টেডির হিড়িক পড়ে যায়। বিশ শতকের সেই টেডি বিয়ারের রূপ অনেক পাল্টেছে কিন্তু টেডির প্রতি ভালোবাসাটা রয়ে গেছে ঠিক আগের মতোই, তাই তো ভালোবাসার মানুষটিকে ভালোবাসার জিনিসটি দেওয়ার জন্যই পালন করা হয় হ্যাপি টেডি ডে। পরিসংখ্যানে দেখা গিয়েছে, উপহার হিসেবে মেয়েরা টেডি বিয়ার অধিক পছন্দ করে। সেই অনুযায়ী পাশ্চাত্যে এই দিনটিকে সামনে রেখে সাশ্রয়ী মূল্যে হরেক রকমের টেডি বিয়ার বাজারজাত করা হয়, যাতে পছন্দের টেডি বিয়ারটি কারো মুখে হাসি ফোটাতে পারে।

ভালোবাসা তো শুধু প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না। আপনার প্রিয় সন্তানকেও উপহার হিসেবে টেডি দিতে পারেন।  উপহার উপলক্ষে ঘরে আসতে পারে দারুন প্রশান্তি। 


১১ ফেব্রুয়ারি :হ্যাপি প্রমিস ডে

ভালেন্টাইন’স ডে পঞ্জিকার পঞ্চম দিনটি হলো ১১ ফেব্রুয়ারি, অর্থাৎ প্রমিস ডে। প্রিয়জনকে আমরা অনেক কথাই দিয়ে থাকি, কিন্তু তার সবই রাখা হয়ে উঠে না, অনেক সময় মনেই থাকে না। তাহলে একবার ভাবুন তো, আপনার কাছের মানুষটির কাছে আপনার মূল্য দিন দিন কমে যাচ্ছে না তো? সম্পর্কের এই দিকটির বিবেচনা করেই প্রমিস ডে। এই দিনটি কেন এত গুরুত্বপূর্ণ? স্বাভাবিকভাবেই কাছের মানুষটি আমৃত্যু একটি প্রতিশ্রুতি চায়,তা হল যে কোনো পরিস্থিতিতে আপনার সহায়তা। নির্দিষ্ট এই দিনটিতে আপনি এই প্রতিশ্রুতিটি করতে পারেন যা আপনাদের সম্পর্কের প্রতিশ্রুতি বজায় রাখতে পারে। 
 
এই দিনে অন্তত একটা প্রমিজ হলেও রক্ষা করুন। সম্পর্ক আরো গাঢ় হতে বাধ্য। 

১২ ফেব্রুয়ারি :হ্যাপি কিস ডে

প্রাচীনকাল থেকে ভালোবাসার গভীরতা, অন্তরঙ্গতা আমরা চুম্বনের মাধ্যমে প্রকাশ করে থাকি। হতে পারে তা আপনার সন্তানের, মায়ের অথবা প্রিয়জনের। ভালেন্টাইন’স ডে পঞ্জিকার ষষ্ঠ দিনটি কিস ডে হিসেবেই পালিত হয়ে আসছে। কিস ডে সর্বপ্রথম ইংল্যান্ডে পালিত হয়। সাংস্কৃতিক কারণে আমাদের দেশে এই দিবসটি তেমন জনপ্রিয় না হলেও পাশ্চাত্যে এর ভিন্ন তাত্পর্য রয়েছে। ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতে কিস ডের একটি জনপ্রিয় আয়োজন হলো ‘চুম্বন প্রতিযোগিতা’, যেখানে প্রতিযোগীদের দীর্ঘ সময় ধরে চুম্বনে আবদ্ধ থাকতে হয়। সেই জুটিই বিজয়ী হবে, যারা সবচেয়ে বেশি সময় ধরে চুম্বনে আবদ্ধ ছিল। গত বছর থাইল্যান্ডের এক জুটি টানা ৫৯ ঘণ্টা পেরিয়ে চুম্বনে প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়। 
বৈধ সম্পর্ক দীর্ঘমেয়াদী রুপ পেতে পারে এই কিস ডে পালনের মাধ্যমে। 

১৩ ফেব্রুয়ারি :হ্যাপি হাগ ডে

প্রিয় মানুষটির সঙ্গ আমরা কে না চাই? শৈশবে মা-বাবার আদর থেকে শুরু করে, বন্ধুর হাত ধরে বন্ধুত্ব এবং সবশেষে জীবন সঙ্গীটির হাত ধরা। আচ্ছা, যখন আমাদের মন খারাপ করে, কারো সঙ্গ পেতে ইচ্ছা করে তখন নিশ্চয়ই আমরা চাই প্রিয় মানুষটিকে জড়িয়ে ধরতে, একাকিত্ব ভাগাভাগি করতে। আপনার প্রিয় মানুষটির একাকিত্বটা সরিয়ে দিতে আপনি না হয় তাকে একটি আলিঙ্গন করলেন। অধিক ব্যস্ততায় মা-বাবাকে সময় দিতে পারছেন না, ফেব্রুয়ারির এই দিনটিতে শৈশবের স্মৃতিটা ফিরিয়ে আনুন আলিঙ্গনবদ্ধ হয়ে।

১৪ ফেব্রুয়ারি :হ্যাপি ভালেন্টাইন’স ডে

একটি সপ্তাহজুড়ে অনুরাগের হরেক দিবস শেষে ভালোবাসার দেবীর আবির্ভাব হয়। বার্ষিক উত্সবের এই দিবসটি প্রেমিক-প্রেমিকার প্রেম অনুরাগের মাধ্যমে অথবা প্রিয় মানুষটির সঙ্গে উদযাপিত হয়। এই দিনে মানুষ তার ভালোবাসার মানুষকে ফুল, চিঠি, কার্ড, গহনা, টেডি প্রভৃতি উপহার প্রদান করে দিনটি উদযাপন করে থাকে।

চলুন দেখে নেই ভ্যালেন্টাইন্স উইকের ইতিহাস

ভালোবাসার গল্পটি শুরু হয়েছিল সেই ২৬৯ খ্রিস্টাব্দে। রোমের চিকিত্সক তরুণ যাজক সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের চিকিত্সায় দৃষ্টি ফিরে পেয়েছিল নগর জেলারের দুহিতা। পরে দুজনের মধ্যে মন দেওয়া-নেওয়া হয়। সেই থেকে জন্ম নিয়েছিল তাদের ভালোবাসার অমরগাঁথা। ভালোবাসার অপরাধে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে ফাঁসিতে ঝুলতে হয় ফেব্রুয়ারির এই ১৪ তারিখে। তারপর এই ভালোবাসার স্বীকৃতি পেতে দুই শতাব্দী নীরবে-নিভৃতে পালন করতে হয়েছে ১৪ ফেব্রুয়ারিকে।

৪৯৬ খ্রিস্টাব্দে রোমের রাজা পপ জেলুসিয়াস এই দিনটিকে ভ্যালেন্টাইন দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। গ্রিক ও রোমান উপকথার মতই ভালোবাসা দিবসের উত্পত্তি নিয়ে আরো গল্প-কাহিনী ছড়িয়ে আছে ভুবনজুড়ে।

দেশে দেশে ভালোবাসা দিবস

উনিশ শতকেই উত্তর আমেরিকায় ভ্যালেন্টাইন’স ডে পালিত হয় ব্রিটিশ অভিবাসীদের মাধ্যমে। যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপক হারে ভ্যালেন্টাইন’স কার্ড বিনিময় শুরু হয় ১৮৪৭ সালে ম্যাসাসুয়েটসের অরকেস্টারে।

বর্তমানকালে, পাশ্চাত্যে এ উত্সব  মহাসমারোহে উদযাপন করা হয়। যুক্তরাজ্যে মোট জনসংখ্যার অর্ধেক প্রায় ১০০ কোটি পাউন্ড ব্যয় করে এই ভালোবাসা দিবসের জন্য কার্ড, ফুল, চকলেট, অন্যান্য উপহারসামগ্রী ও শুভেচ্ছা কার্ড ক্রয় করতে, এবং আনুমানিক প্রায় ২.৫ কোটি শুভেচ্ছা কার্ড আদান-প্রদান করা হয়।

বাংলাদেশে বসন্ত ঋতুর ক্ষণগণনা শুরু হয় ১৩ ফেব্রুয়ারি থেকে, যার একদিন পরেই ভালোবাসা দিবসটি। বাংলাদেশে এ দিবসটি পালন করা শুরু হয় ১৯৯৩ সালে। একদিন আগে পরে এই দুইটি দিন উদযাপিত হওয়ায় আমাদের দেশের যুবক-যুবতীদের উত্সব সংস্কৃতিতে মহোত্সবের রূপ পেয়েছে এই দিবসটি। শুধু তারুণ্যই নয়, প্রৌঢ় থেকে শুরু করে শিশু, কিশোর, মধ্যবয়সীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে এর আবহ। এ দিনে  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, চারুকলা, ধানমন্ডির রবীন্দ্রসরোবর, সংসদ ভবন চত্বর, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, রমনা বটমূল, চন্দ্রিমা উদ্যান মুখরিত থাকবে সারা দিন। ‘সখী ভালোবাসা কারে কয়’—বহু বছর আগে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এভাবেই ভালোবাসার অর্থ খুঁজেছিলেন। কারণ, ভালোবাসার অর্থ যে গভীর দ্যোতনাময়। এই অর্থটি বুঝতে এবং বুঝাতে আপনিও ভালেন্টাইন’স পঞ্জিকার সাতটি দিন উদযাপন করতে পারেন আপনার প্রিয়জনকে নিয়ে। তাহলে কি শুধু একটি দিন বা একটি সপ্তাহ ভালোবাসার জন্য? অবশ্যই নয়। 

ভালোবাসা সারা বছরের, সারা দিনের। তাই ভালোবাসার মানুষটির বা মানুষগুলোর সাথেই থাকুন, তাদের সাথেই উপভোগ করতে পারেন নববসন্তের প্রকৃতি।

তবে এবারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। মহামারি করোনা ভাইরাসের কারনে এবার বাংলাদেশের বসন্তবরণ উৎসব বাতিল করা হয়েছে। চারুকলার বকুলতলায় এবার আর বসন্তবরণ উৎসব হবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং এর আশপাশের এলাকায় জনসমাগম এড়াতে কঠোর বার্তা আসতে পারে আইন শৃংখলা বাহিনীর পক্ষ থেকে। 

সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখে ভার্চুয়াল জগতেই হবে এবার ভালোবাসা দিবস উৎযাপন।

সবাইকে ভালোবাসা দিবসের অগ্রীম শুভেচ্ছা। পরিবার, সন্তান এবং প্রিয়জনের সঙ্গে উৎযাপন করুন বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন্স ডে।