মার্কিন প্রেসিডেন্টের অভিষেক কেন ২০ জানুয়ারি হয়?
নানা ঘটনার জন্ম দিয়ে ভীষণ উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আগামী ২০ জানুয়ারি শপথ নিতে যাচ্ছেন নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। নিয়ম অনুযায়ী ২০ জানুয়ারি দুপুরে শপথ নেওয়ার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে অভিষিক্ত হবেন তিনি। চার বছর আগে ২০১৭ সালের ২০ জানুয়ারি অভিষিক্ত হয়েছিলেন এবার বিদায় নিতে যাওয়া প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাঁর আগের বারাক ওবামাসহ সাম্প্রতিক সব মার্কিন প্রেসিডেন্টের অভিষেকই এই বিশেষ তারিখে হয়েছে। কিন্তু কেন ও কবে থেকে এই বিশেষ দিনে নতুন প্রেসিডেন্টের অভিষেকের এই রেওয়াজ পালন করা হচ্ছে?
পৃথিবীর সব দেশেই সরকার বদলের ক্ষেত্রে কিছু বিশেষ রেওয়াজ রয়েছে। একেক দেশের ক্ষেত্রে একেক রকম বিষয়টি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের মতো এত সুনির্দিষ্ট কোনো দেশেই সম্ভবত নেই। এই যেমন এই ২০২১ সালে দাঁড়িয়েই বলে দেওয়া যাচ্ছে, আগামী ২০২৫ সালের ২০ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট শপথ নেবেন। দেশটির সাধারণ নির্বাচন থেকে শুরু করে নতুন প্রেসিডেন্টের শপথ গ্রহণসহ প্রতিটি ধাপ খুবই সুনির্দিষ্ট করা আছে।
কেন ২০ জানুয়ারিতেই যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্টরা শপথ নেন? উত্তর- সংবিধান। মার্কিন সংবিধানের ২০তম সংশোধনী অনুযায়ী, নভেম্বরের নির্বাচনের পরের বছরের ২০ জানুয়ারি দুপুরে নতুন প্রেসিডেন্ট শপথ নেওয়ার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের নির্বাহী প্রধান হিসেবে অভিষিক্ত হবেন। ওই দিন বেলা ১১টা ৫৯ মিনিট ৫৯ সেকেন্ড পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবেন বিদায়ী প্রেসিডেন্ট। এই সময়ের পর আর তিনি ক্ষমতায় থাকবেন না। এবার যেমন ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সি আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হচ্ছে ২০ জানুয়ারি ঠিক দুপুরে।
কবে থেকে এই রেওয়াজ?
গবেষণা বিষয়ক পত্রিকা লাইভ সায়েন্সের প্রতিবেদন মতে, সময়ের হিসাব করলে এই রেওয়াজের বয়স শত বছরও হয়নি। সুস্পষ্টভাবে বললে, ১৯৩৭ সালের ২০ জানুয়ারি প্রথম কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট। ওটা ছিল তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদ। প্রথম মেয়াদে তিনি শপথ নিয়েছিলেন সংবিধানে উল্লিখিত ৪ মার্চ। এবং তাঁর আগের সব মার্কিন প্রেসিডেন্টই ওই ৪ মার্চই শপথ নিয়েছেন, ১৭৮৯ সালের সংবিধানের ধারাবাহিকতা মেনে।
প্রশ্ন হলো, নির্বাচনের পর থেকে নতুন প্রেসিডেন্টের শপথ নেওয়ার মধ্যে এত বড় বিরতি কেন? মূলত দুটি কারণে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রথম কারণটি এই সময়ে শুনতে একটু কেমন লাগলেও সত্য। সেটি হলো, নির্বাচিত নতুন প্রেসিডেন্টের ওয়াশিংটনে এসে ক্ষমতা গ্রহণের জন্য আসাটা সময় সাপেক্ষ বিষয়। আগে যোগাযোগ ব্যবস্থা বেশ খারাপ ছিল। ফলে, দূরের প্রান্ত থেকে কেউ এসে ক্ষমতা গ্রহণ করতে যেন কোনো অসুবিধা না হয়, সে জন্য একটা লম্বা সময় এই ভ্রমণের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়। দ্বিতীয় কারণটিই মুখ্য, আর তা হলো ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া। ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য বিদায়ী প্রশাসনের কাছ থেকে নানা তথ্য নতুন প্রশাসনকে দেওয়া, নতুন প্রশাসনের মন্ত্রিপরিষদ গঠনের সঙ্গে সঙ্গে পুরো প্রশাসনে নিয়োগ দেওয়া ইত্যাদি কাজের জন্য একটা সময় প্রয়োজন। আগে প্রযুক্তি উন্নত ছিল না। ফলে নির্বাচনের পর ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে শপথ গ্রহণের জন্য মোটাদাগে চার মাসের একটা সময় রাখা হতো।
সমস্যা হয় ১৮৬১ সালে। সে বছর মার্চে আব্রাহাম লিঙ্কন ক্ষমতা গ্রহণ করতে করতে চলমান গৃহযুদ্ধে মার্কিন পক্ষের পরাজয় প্রায় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। এই একই অবস্থার মুখোমুখি হতে হয়েছিল সাত দশক পর ১৯৩৩ সালে। মহামন্দার সেই সময়ে সাবেক প্রেসিডেন্ট হার্বার্ট হুভারের কাছ থেকে ক্ষমতা নেন ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট। অবস্থা এতটাই বাজে ছিল যে, মানুষ উদ্গ্রীব হয়ে শুধু ক্ষমতা হস্তান্তরের অপেক্ষা করছিল।
সেই বছরই প্রথম এই দীর্ঘ বিরতি একটা বড় সমস্যা হিসেবে সামনে হাজির হয়। আনা হয় সংবিধানের ২০তম সংশোধনী, যেখানে নতুন প্রেসিডেন্টের অভিষেকের দিন হিসেবে ২০ জানুয়ারির কথা বলা হয়। তবে এ ক্ষেত্রে একটি ব্যতিক্রম রয়েছে। কোনো বছরের ২০ জানুয়ারি যদি রোববার পড়ে, তবে প্রেসিডেন্ট শপথ নিলেও বাকি আনুষ্ঠানিকতা পরদিনের জন্য তোলা থাকবে। সর্বশেষ ২০১৩ সালে বারাক ওবামার দ্বিতীয় মেয়াদের সময় এমন ঘটনা ঘটেছিল।
মার্কিন সরকারি ওয়েবসাইটের তথ্যমতে, যেহেতু বিদায়ী প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার মেয়াদ ওই দিন ঠিক দুপুর পর্যন্ত, সেহেতু তার খুব কাছাকাছি সময়েই শপথ পাঠের বিষয়টি সেরে ফেলার চেষ্টা করা হয়, যাতে কোনো নেতৃত্বের শূন্যতা সৃষ্টি না হয়। সেই থেকে এখন পর্যন্ত জরুরি অবস্থা ছাড়া এই নিয়মের কোনো ব্যত্যয় হয়নি। বদলায়নি শপথবাক্যও, যা মার্কিন সংবিধানের ২০তম সংশোধনীর অনুচ্ছেদ ২-এর সেকশন-১-এ উল্লেখ করা আছে। যদিও ২০০৯ সালে সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রথম মেয়াদের শপথ গ্রহণের আগে সুপ্রিম কোর্টে ওঠা একটি মামলার জেরে ‘সো হেল্প মি6 গড’ অংশটি এখন আর শপথ গ্রহণের সময় পাঠ করা হয় না। এমনিতে প্রধান বিচারপতি এই শপথবাক্য পাঠ করানোর রেওয়াজ থাকলেও এ ক্ষেত্রে কোনো সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা নেই।
মাত্র ৩৫ শব্দের এই শপথবাক্য পাঠের মধ্য দিয়ে আগামী ২০ জানুয়ারি জো বাইডেন বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশটির শীর্ষ পদে বসবেন। কি সেই শপথ বাক্য? খুবই ছোট এই শপথবাক্যে রয়েছে, ‘আমি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে শপথ নিচ্ছি (বা দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করছি) যে, আমি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট কার্যালয়ের দায়িত্ব বিশ্বস্ততার সঙ্গে পালন করব এবং আমার সর্বোচ্চ ক্ষমতা দিয়ে মার্কিন সংবিধানের সংরক্ষণ, এর সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করব।’—এটুকুই। তবে এর আগে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কমলা হ্যারিস যে শপথটি নেবেন, তা দৈর্ঘ্যে প্রেসিডেন্ট এর শপথ বাক্যের চেয়ে বড়। শপথটি প্রেসিডেন্ট চাইলে বাইবেল ছুঁয়ে বা না ছুঁয়ে করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে কোনো নির্দেশনা নই। তবে অধিকাংশ মার্কিন প্রেসিডেন্টই বাইবেল বা অনুরূপ কোনো বই বা লেখা ছুঁয়ে শপথ নেন। এই শপথ অনুষ্ঠানের পরপরই বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ফার্স্ট লেডিসহ অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করেন।
এ বছর করোনা মহামারির কারণে এবং গত ৬ জানুয়ারি ডোনাল্ড ট্রাম্প সমর্থকদের ক্যাপিটল হিল হামলার জেরে অভিষেক অনুষ্ঠানের পরিসর অনেক ছেঁটে ফেলা হলেও সাধারণত ক্যাপিটল হিলের ওয়েস্ট ফ্রন্টের সামনের লনে উন্মুক্ত মঞ্চে এই অনুষ্ঠান হবে। গত ১৫ ডিসেম্বরই এবারের অনুষ্ঠানের নতুন ধরন সম্পর্কে জানিয়ে দেওয়া হয়। সে সময়ই জানানো হয়, সাধারণ মানুষের জন্য এবার আর আগের মতো অনুষ্ঠান উন্মুক্ত থাকছে না। এমনিতে অভিষেকে যোগ দিতে নিবন্ধন করতে হয়, যার নিয়ন্ত্রণটি থাকে কংগ্রেসের হাতে। যে কেউ নিজের এলাকার কংগ্রেস সদস্যদের মাধ্যমে বিনা মূল্যে টিকিট সংগ্রহ করতে পারে। অভিষেক অনুষ্ঠানবিষয়ক কংগ্রেস কমিটি নির্ধারণ করে, কতজন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারবে। সেই হিসাবের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন এলাকার বিপরীতে টিকিট বরাদ্দ করা হয়, যা বিলি করেন সংশ্লিষ্ট কংগ্রেস সদস্যরা। এবার আগে থেকেই সবাইকে ঘরে থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
তবে ঘরে থাকার মানে অভিষেক অনুষ্ঠান না দেখা নয়। ভার্চ্যুয়ালি অনুষ্ঠানটি দেখা যাবে। আর সিএনএন, এবিসি, এনবিসি, সিবিএস, এমসএনবিসি ও ফক্স-এর মতো সম্প্রচারমাধ্যমগুলো তো রয়েছেই, যারা সরাসরি দেখাবে অভিষেক অনুষ্ঠান। এবার এই সরাসরি অনুষ্ঠান দেখেই আশ মেটাতে হবে। করোনা এমন অনেক কিছুই বদলে দিয়েছে। অভিষেকের আগের নানা জমকালো অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়েছে। বিশিষ্টজনদের নিয়ে নৈশভোজ, অভিষেকের পূর্ণাঙ্গ মহড়াসহ অনেক কিছুই বাতিল করা হয়েছে। প্রেসিডেনশিয়াল প্যারেডের পরিসরও ছোট করে আনা হয়েছে। প্যারেডের সময় রাস্তার দুপাশে থাকবে না মানুষের ভিড়। অনুষ্ঠানস্থলে তারপরও যাদের থাকার সৌভাগ্য হবে, তাঁদের মুখে থাকবে মাস্ক। আর শারীরিক দূরত্ব হিসেবে ছয় ফুট দূরত্ব মেনে চলার বিষয়টি তো রয়েছেই।
জমকালো এই অনুষ্ঠানের ব্যয় বহন করে কারা?
স্বাভাবিকভাবেই এর একটি অংশ আসে করদাতাদের কাছ থেকে। বাকিটা আসে আলাদাভাবে সংগৃহীত অনুদান থেকে। এ ক্ষেত্রে অভিষেক সম্পর্কিত কংগ্রেস কমিটি, প্রেসিডেনশিয়াল অভিষেক কমিটি, ফেডারেল সরকার এবং অঙ্গরাজ্য ও স্থানীয় সরকারগুলো যৌথভাবে ব্যয় বহন করে। পরিসর ছোট হওয়ায় এবার নিঃসন্দেহে এই ব্যয় অনেক কম হবে। তবে মূল অনুষ্ঠান ছোট হলেও আতশবাজি বা নাগরিকদের আনন্দ উল্লাসে খুব একটা বাধা থাকবে না। নিরাপত্তা নিশ্চিত থাকলে এ নিয়ে তেমন কিছু বলবারও নেই। নতুন পরিস্থিতিতে এবারের অভিষেক অনুষ্ঠান নানাভাবেই উল্লেখযোগ্য হয়ে থাকবে। কারণ, এবার ফার্স্ট লেডিসহ সদ্যসাবেক হওয়া প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সসম্মানে ও সগৌরব বিদায় সম্ভবত বিশ্ববাসী দেখবে না, যা মার্কিন প্রেসিডেন্সি বদলের ক্ষেত্রে একটি আইকনিক দৃশ্য হিসেবে বরাবর বিবেচিত হয়ে আসছে।