রাজধানীতে লকডাউন ও নাগরিক ভাবনা
করোনার ভাইরাসের উচ্চ সংক্রমণ প্রতিরোধে সোমবার থেকে সারাদেশে এক সপ্তাহের লকডাউন ঘোষণা করেছে সরকার। আজ ছিলো প্রথম দিন। তবে এবারের লকডাউনের চিত্র বেশ ভিন্ন দেখা গেছে রাজধানী জুড়ে। সড়কে গণপরিবহণের দেখা মেলেনি। কিন্তু ব্যক্তিগত গাড়ি, রিকশা, মটরসাইকেল, সিএনজির চলাচল ছিলো চোখে পড়ার মত। বাইরে সাধারণ মানুষের উপস্থিতি কিছুটা কম থাকলেও সবাইকে স্বাভাবিকভাবেই চলাচল করতে দেখা যায়।
এক কথায় বলা যায়, লকডাউনের প্রথম দিনে এক প্রকার ছুটির আমেজে ছিলো রাজধানীবাসী। যদিও লকডাউনের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাইরে বের হতে বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। তবে সেই নির্দেশনা মানার ক্ষেত্রে অনেকটা উদাসীনভাব দেখা গেছে নগরবাসীর মধ্যে।
মোহাম্মদপুর তাজমহল রোডের একটি চায়ের দোকেন বসে চা খাচ্ছিলেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আনিস রহমান। বলছিলেন লকডাউন নিয়ে তার অভিজ্ঞতা। আনিস বলেন, সকাল থেকেই গলিতে গলিতে ঘুরে ঘুরে তরকারি বিক্রি করেছি। অন্যান্য দিনের তুলনায় বিক্রি কিছুটা কম। তবে লকডাউনের কারণে ঘরে বসে থাকলে তো না খেয়ে মরতে হবে। এসময় লকডাউনের কারণে তাকে এখন পর্যন্ত কোথাও বাধার মুখে পড়তে হয়নি বলেও জানান তিনি।
ধানমন্ডি ১৫ নম্বর এলাকায় কথা হচ্ছিল রিকশা চালক ইয়ারউদ্দিনের সাথে। কুড়িগ্রাম থেকে বছর দুই আগে ঢাকায় এসেছেন। এলাকায় খুব একটা কাজের সুযোগ না থাকায় ভালো উপার্জনের আশায় রাজধানীতে এসে রিকশা চালাচ্ছেন। গতবারের লকডাউনের তিক্ত অভিজ্ঞতা খুব ভালোভাবেই অনুধাবন করেছেন তিনি। বলছিলেন ভিক্ষা করে আর ত্রাণের আশায় বসে থাকতে হতো তাকে। না খেয়েও দিন কেটেছে বহু বেলা। এবার তাই অনেকটা ঝুকি নিয়ে সকালে পেটের তাগিদে রিকশা নিয়ে বের হয়েছেন তিনি। তবে রাস্তায় বের হয়ে তিনি দেখেন অন্যান্য দিনের মত অনেকটা স্বাভাবিকভাবেই রিকশা চলাচল করছে রাজধানীতে। তিনি বলেন আমাদের মতো খেটে খাওয়া মানুষ লকডাউন মানতে চাইবে না। কারণ একদিন ঘরে বসে থাকলেই খাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। আর যাদের সাথে পরিবার আছে তাদের চিন্তা তো আরও বেশি।
ইয়ারউদ্দিনের কথার সত্যতা পাওয়া যায় রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক এবং এর আশেপাশের দোকানপাটের দিকে চোখ পড়লে। মূল সড়কের পাশের দোকানপাট বন্ধ থাকলেও বেশ কিছু দোকান খোলাও পাওয়া যায় ধানমন্ডি এলাকায়। স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রেও অনেকের মধ্যে দেখা যায় উদাসীনতা। কাউকে দেখা গেছে সাথে মাস্ক আছে ঠিকই তবে সেটা মুখে পরেননি, গলায় ঝুলিয়ে রেখেছেন। আবার কেউ মাস্ক পরার প্রয়োজনীয়তাই বোধ করছেন না। কাউকে কাউকে আবার দেখা গেছে কোন প্রয়োজন ছাড়াই রাস্তায় ঘোরাফেরা করতে।
এমনই কয়েকেজনের মধ্যে ছিলেন সাদমান ও আরিফ নামে দু’জন। কয়েকজন বন্ধু মিলে বেলা ১২টার দিকে আড্ডা দিচ্ছিলেন জিগাতলা বাসষ্ট্যান্ড সংলগ্ন ধানমন্ডি লেকের পাশে। এরা সবাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী। দেখা যায় এদের কারো মুখে মাস্ক আছে আবার কারো সাথে মাস্ক নেই। ছিলো না নিজেদের মধ্যে সামাজিক দুরত্ব মানার বিধিনিষেধও। লকডাউনের মধ্যে এভাবে বাইরে বের হওয়া ঠিক হয়েছে কিনা জানতে চাইলে, তারা বলেন এভাবে বের হওয়াটা ঠিক হয়নি।
তবে তারা দাবি করেন, কেউই তো লকডাউন তেমন মানছে না। সব কিছুই স্বাভাবিক নিয়মে চলছে। তারা মনে করেন নিজেদেরকে সচেতন হওয়ার পাশাপাশি সরকারের আরও দায়িত্বশীল হওয়া প্রয়োজন। এভাবে সবকিছু চলতে দিয়ে লকডাউন ঘোষণার মধ্য দিয়ে করোনা সংক্রমণ কতটা নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তারা।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন মাহাবুব হোসেন। তিনি জানান তার অফিসও খোলা। চাকরি বাঁচাতে হলে তো অফিসে আসতেই হবে। তাই তিনি বাসা থেকে বের হয়েছেন। তবে পরিবারকে গতকালই বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। খরচ বাঁচানোর জন্য। এদিকে করোনা ভাইরাসের বর্তমানে সংক্রমণের মাত্রা নিয়েও শংকা প্রকাশ করেন তিনি। বলেন, কাজের প্রয়োজনে অফিসে কিংবা বাইরে অনেকের সাথেই মিশতে হয়। অনেক সময় স্বাস্থ্যবিধিও ঠিকমত মানা হয় না। আবার জীবিকার তাগিদে ঘরে বসে থাকার উপায়ও নেই। এখন সবকিছু ভাগ্যের উপর ছেড়ে দেওয়া ছাড়া কোন গতি নেই।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় গত ২৯ মার্চ বেশ কিছু বিধিনিষেধসহ ১৮ দফা নির্দেশনা জারি করেছে সরকার। এর মধ্যে ঘরের বাইরে গেলে মাস্কের ব্যবহার অন্যতম। কিন্তু সংক্রমণ আশঙ্কাজনকভাবে বাড়তে থাকলেও জনগণের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে এখনো উদাসীনতা দেখা যাচ্ছে। জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে হলে মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি মানার বিকল্প নেই।
এদিকে টানা দুদিন ধরে দেশে করোনায় শনাক্ত রোগী ৭ হাজারের বেশি। দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা শনাক্ত হয়েছে ৭ হাজার ৭৫ জনের। আর মারা গেছেন ৫২ জন। আগের দিন রোববার করোনা শনাক্ত হয়েছিল ৭ হাজার ৮৭ জনের, যা দেশে করোনা সংক্রমণ শুরুর পর থেকে এক দিনে ছিল সর্বোচ্চ। গতকাল করোনার সংক্রমণে মারা গেছেন ৫৩ জন।
এ বছর মার্চে শুরু হয়েছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। প্রথম ঢেউয়ের চেয়ে এবার সংক্রমণ বেশি তীব্র। মধ্যে কয়েক মাস ধরে শনাক্তের চেয়ে সুস্থ বেশি হওয়ায় দেশে চিকিৎসাধীন রোগীর সংখ্যা কমে আসছিল। কিন্তু মার্চ মাস থেকে চিকিৎসাধীন রোগীর সংখ্যাও আবার বাড়তে শুরু করেছে।