কালোজাম চাষের বাণিজ্যিক ক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছে
বিশ্বে খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশের সাফল্য বিশ্বয়কর। প্রচলিত ও অপ্রচলিত ফলের চাষ সম্প্রতিক সময়গুলোতে আশাতীতভাবে বেড়ে চলছে। এমনি একটি ফল কালোজাম। ফলটি ব্যাপকভাবে বাণিজ্যিক চাষ বা বাগান না হলেও সম্প্রতি বছরগুলোতে বসতবাড়ী ও আশাপাশের পতিত জমিতে বেড়েই চলছে। আমের মতো গ্রীষ্মকালের আরেকটি ফল কালোজামের উৎপাদন সম্প্রতি বছরগুলোতে বেড়ে গেছে বলে ফলবিদরা জানিয়েছেন। ফলবিদরা জানিয়েছেন, কৃষি অধিদপ্তরের বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্প এক্ষেত্রে অগ্রনী ভূমিকা পালন করছে।
বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে রোববার সকালে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার-১৪২৪ প্রদান অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা বলেন, আজ বিশ্বে বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে তৃতীয়, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, পাট উৎপাদনে দ্বিতীয়, চা উৎপাদনে চতুর্থ এবং আলু ও আম উৎপাদনে সপ্তম স্থান অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি অর্জনে ছয়টি থিমেটিক এরিয়াতে কাজ করে যাচ্ছি (১) কৃষি গবেষণা ও উন্নয়ন, (২) কৃষি উপকরণ সরবরাহ, (৩) কৃষি সম্প্রসারণ, (৪) সেচ কাজে পানির সাশ্রয়ী ব্যবহার, (৫) জলবায়ুর পরিবর্তন জনিত প্রভাব মোকাবিলা এবং (৬) প্রতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি ও মানবসম্পদ উন্নয়ন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হর্টিকালচার উইং সূত্র জানায়, গত ৮ বছর ধরে প্রতিবছরে অল্প অল্প করে প্রায় ৩ গুণ বেড়েছে লোভনীয় এ কালোজাম চাষ। এসময় সামান্য করে হলেও ফলটি চাষের জমি বেড়েছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৬ হাজার ১৪২ হেক্টর জমিতে ৩৭ হাজার ৩৪৬ টন থেকে বেড়ে ২০১৯-২০ মৌসুমে ৬ হাজার ৫৬০ হেক্টর জমিতে ১ লাখ ১৯ হাজার ৮৮০ টন কালোজাম উৎপাদন হয়েছে।
পুষ্টিবিদদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, কালচে বেগুনি রঙের এ ফলটি খেতেও যেমন সুস্বাদু, তেমনই পুষ্টিগুণে ভরা। ছোটদেরও এই ফল বেশ পছন্দের। যেকোনও বেরি জাতীয় ফলই খুব উপকারী। আর তার মধ্যে একটি হল কালো জাম বা ব্ল্যাকবেরি। এটি ত্বক ও চুলের সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্যের জন্যও বেশ উপকারি।
কালো জামে প্রচুর পরিমানে বিভিন্ন উপকারি উপাদান যেমন, ক্যালসিয়াম, আয়রন, ফসফরাস, সোডিয়াম, এছাড়াও ভিটামিন এ, সি, বি-৬, ও আরও আনেক উপকারী উপাদান থাকে। যা শরীরকে ভালো রাখার জন্য প্রতিদিন দরকার। শুধু ফলই নয়, এর পাতা ও বীজ বিভিন্ন চিকিৎসার কাজে ব্যবহার করা হয়। কালো জাম বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে পরিচিত। এটি খাওয়াও সহজ খোসা ছাড়াবার দরকার পড়ে না। কালো জাম অনেকদিন ধরেই ডায়াবেটিসের চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হয়। কালো জামের মধ্যে আছে এমন কিছু উপাদান যা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ভীষণ ভাবে সাহায্য করে। বিশেষ করে এর বীজ রক্তের সুগার লেবেল কমাতে একটি প্রমাণিত সমাধান। কালো জামকে ডায়াবেটিস বিরোধী বলা হয়। কালো জাম হলো অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের ভাণ্ডার। অন্যান্য যেকোনো ফল বা সব্জি যেগুলো সাধারণত রোজ খাওয়া হয় সেগুলো থেকে কালো জামে সবচেয়ে বেশি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে।
রোজকার জীবনে এ অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট খুবই প্রয়োজনীয়। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীরকে ভেতর থেকে ফিট রাখে। ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। কালোজাম হজম করতে সাহায্য করে। হজমের কারণে হওয়া অ্যালসার প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। এছাড়াও দাঁত ভালো রাখে। স্পাইরিয়ার সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে সাহায্য করে। এছাড়াও ত্বককেও ভালো রাখতে এটি উপকারী। ত্বকের বিভিন্ন সমস্যা দূর করতে এটি ব্যবহার করা হয়।
ত্বকের যত্নে জাম গুরুত্বপূর্ণ। জাম রক্ত পরিষ্কার রাখে। তার ফলে ত্বক ভালো থাকে। এবং ত্বকের নানান সমস্যা থেকেও মুক্তি পাওয়া যায় এবং ওজন কমাতেও কালোজাম সাহায্য করে। এছাড়াও কালো জাম সর্দি কাশি কমাতে সাহায্য করে। যদি খুব সর্দিকাশিতে ভোগেন তাহলে রোজ কালোজাম খান। এতে থাকা ভিটামিন এ, সি, বি-৬ শরীরের রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা বাড়ায়। জামের বীজ বহুমুত্র রোগ নিরাময়ে ব্যবহার করা হয়। নিয়মিত খেলে এই সমস্যা থেকে মুক্তি মেলে সহজে। গরমকালে আম খাবার সঙ্গে সঙ্গে কালোজাম কেও রোজ যোগ করে নিন খাবার তালিকায়।
অনিয়মিত লাইফস্টাইলে বর্তমানে ক্যান্সারের ঝুঁকি ভীষণভাবে বেড়েছে। আর কালো জাম ক্যান্সার প্রতিরোধে ভীষণভাবে সাহায্য করে। এতে থাকা প্রচুর পরিমানে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীরকে কান্সারে আক্রান্ত হবার হাত থেকে রক্ষা করে। কালো জাম শরীরে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়তে দেয়না। এছাড়া এটি প্রস্টেট ক্যান্সার সারিয়ে তুলতে বিশেষ ভাবে সাহায্য করে।
কালো জাম শরীরকে ভালো রাখার সঙ্গে সঙ্গে মনকে ভালো রাখতেও সাহায্য করে। এতে থাকা গ্লুকোজ কাজ করার শক্তি বাড়ায় ও স্মৃতিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চালন বাড়ে। তার ফলে মস্তিষ্ক দ্রুত চলতে থাকে। স্ট্রেসকে কমাতে সাহায্য করে। কালো জাম হার্টকে ভালো রাখতেও সাহায্য করে। এতে থাকা ভিটামিন সি, বি-৬, ফাইবার, রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমান কমায়। তার ফলে হার্ট সুস্থ থাকে ও হার্টের অসুখে আক্রান্ত হবার সম্ভবনা থাকে না। এছাড়াও এটি শরীরে দুষিত কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমান কমায় এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতেও বিশেষ ভাবে সাহায্য করে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) এর বিভিন্ন কেন্দ্রে কালোজামের মাতৃগাছ আছে। ২০১৮-১৯ মৌসুমে বারি কালোজাম-১ নামের একটি কালোজাম অবমুক্ত হয়েছে। আরও কয়েকটি অবমুক্তির অপেক্ষায় আছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্প (২য় সংশোধিত) এর প্রকল্প পরিচালক কৃষিবিদ ড. মো. মেহেদী মাসুদ জানান, কালোজাম চাষে কৃষকদের সহায়তার জন্য আমরা সর্বদা কাজ করছি। মৌচাক হর্টিকালচার সেন্টারের জাম বাগানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের জামের চারার সম্বন্বয় ঘটিয়েছি আমরা।
তিনি আরো বলেন, পাহাড়সহ চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, যশোর, ময়মনসিংহ, রংপুর ও দিনাজপুরসহ দেশের প্রায় সর্বত্র কালোজাম কমবেশি হয়ে থাকে। দেশের সব হর্টিকালচার সেন্টার থেকে কালোজামের চারা বা কলম বিতরণ করা হয়। কাশিয়ানি সেন্টারে প্রকল্পের পক্ষ থেকে ইন্দোনেশিয়া থেকে আনা একটি কালোজামের চারা এনে লাগানো হয়েছিলো। ঐ গাছটি বছরে দুই বার ফল দেয়। গাছটিতে সুমিষ্ট প্রচুর ফল হয়েছে। দেশের সব রাস্তার দুধারে এবং মসজিদ, মন্দির, গির্জা, কবরস্থান, শশ্মানসহ এ ধরনের প্রতিস্থানের আশপাশে কালোজাম গাছের চারা লাগানো যেতে পারে।