সাতক্ষীরায় ৩ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা


প্রকৌশল প্রতিবেদক :
সাতক্ষীরায় ৩ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা
  • Font increase
  • Font Decrease

সাতক্ষীরা শহরের পারকুকরালির হোমিও চিকিৎসক মোখলেছুর রহমান জনি সদর থানা লকআপ থেকে নিখোঁজের পাঁচ বছরেও সন্ধান মেলেনি। এ ঘটনায় মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশে মঙ্গলবার জনির বাবা শেখ আব্দুর রাশেদ বাদি হয়ে ছেলেকে অপহরণ করে খুন করার পর লাশ গুম করার অভিযোগ এনে সাতক্ষীরার মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে মামলা দায়ের করেছেন।

মামলায় সদর থানার তৎকালিন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এমদাদ শেখ, ফিরোজ হোসেন মোল্লা ও উপ-পরিদর্শক হিমেলকে আসামি করা হয়েছে। সাতক্ষীরার মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতের বিচারক মোঃ হুমায়ুন কবীর মামলার কাগজপত্র পর্যালোচনা করে আদেশের জন্য বুধবার দিন ধার্য করেছেন।

মামলা ও ঘটনার বিবরণে জানা যায়, ২০১৬ সালের ৪ আগষ্ট রাত সাড়ে ৯টার দিকে অসুস্থ বাবার জন্য ঔষধ কিনতে গিয়ে বাড়ী ফেরার সময় সাতক্ষীরা শহরের লাবনী সিনেমা হলের সামনে থেকে সদর থানার উপ-পরিদর্শক হিমেল শহরের পারকুকরালির শেখ আব্দুর রাশেদ এর ছেলে হোমিও চিকিৎসক মোখলেছুর রহমান জনিকে (২৭) থানায় ধরে নিয়ে যান। ২০১৬ সালের ৫, ৬ ও ৭ আগষ্ট জনির স্ত্রী জেসমনি নাহার রেশমা তার শ্বশুর ও স্বজনদের নিয়ে থানা লক আপে তাকে খাবার দিয়েছেন, তার সঙ্গে কথা বলেছেন। থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এমদাদুল হক শেখ ও উপ-পরিদর্শক হিমেলের সঙ্গে কথা বললে জনির জঙ্গি সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে জানানো হয়। স্বামীর মুক্তির বিনিময়ে তৎকালিন থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও উপ-পরিদর্শক হিমেল জনির স্ত্রী রেশমার কাছে দাবি করেন মোটা অংকের টাকা।

২০১৬ সালের ৮ আগষ্ট থানায় গেলে জনিকে পাওয়া যায়নি। পুলিশ জনির অবস্থান সম্পর্কে জানাতে পারেনি। বিষয়টি সাংবাদিক, জনপ্রতিনিধি, ক্ষমতাসীন দলের নেতা, মানবাধিকার কর্মী, জেলা প্রশাসক ও পুলিশের উর্দ্ধতন কর্মকর্তাকে অবহিত করা হয়। ওই বছরের ২৪ আগষ্ট বিষয়টি জানানো হয় সাতক্ষীরা পুলিশ সুপারকে। ওই বছরের ২৬ ডিসেম্বর থানায় সাধারণ ডায়েরী করতে গেলে থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফিরোজ হোসেন মোল্লা গ্রহণ করেননি।

কোন উপায় না দেখে ২০১৭ সালের ৩ জানুয়ারি সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন নিখোঁজ ডাক্তার জনি’র স্ত্রী রেশমা। ২০১৭ সালের ২১ জানুয়ারি আইন ও শালিস কেন্দ্রের তদন্তকারি টিমের সদস্য অনির্বান সাহা, মানবাধিকার কর্মী রঘুনাথ খাঁসহ কয়েকজন জনির বাড়িতে আসেন ও পরে থানায় যান। যা পরদিন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

অবশেষে ২০১৭ সালের ২ মার্চ হাইকোর্টে রিট পিটিশন (২৮৩৩/১৭) দাখিল করেন জেসমিন নাহার রেশমা। মামলায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ আটজনকে বিবাদী করা হয়। আদালতের নির্দেশে ২০১৭ সালের ১৯ মার্চ আদালতে উপস্থাপন করা পুলিশ সুপারের ব্যাখ্যায় বলা হয়, নিখোঁজ মোখলেছুর রহমান নিষিদ্ধ সংগঠন ‘আল্লাহর দল’এর সঙ্গে যুক্ত এবং তাকে গ্রেপ্তার করা হয় নাই।

২০১৭ সালের ১৯ মার্চ শুনানী শেষে আদালত জনিকে ১২ এপ্রিলের মধ্যে বিচারিক আদালতে হাজির করানোর নির্দেশ দেন। একই সাথে ৯ মে এ সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ঢাকা লিগ্যাল সেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এ এস এম জাভিদ হাসানকে নির্দেশ দেওয়া হয়। সে অনুযায়ি একরামুল হাবিব সাতক্ষীরা পুলিশ সুপার আলতাফ হোসেন পিপিএমসহ ১০জন পুলিশ সদস্য ও পাঁচজন সাধারণ মানুষের জবানবন্দি নিয়ে মোখলেছুর রহমান জনিকে ২০১৬ সালের ৪ আগষ্ট পুলিশ আটক করেনি বা তাকে কেউ থানার মধ্যে দেখেনি মর্মে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেন।

পরে আদালতের নির্দেশে ২০১৭ সালের বছরের ৩ জুলাই আবার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। প্রতিবেদনে থানা লক আপ থেকে জনির নিখোঁজ হওয়ার সত্যতা পাওয়া গেছে মর্মে প্রতীয়মান হয়। পরবর্তীতে এক আদেশে ওই বছরের ৩ অক্টোবরের মধ্যে এ সম্পর্কিত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য পিবিআইকে (পুলিশ ব্যুরো ইনভেসটিগেশন) নির্দেশ দেওয়া হয়।

পিবিআই'র তদন্ত প্রতিবেদনে জনিকে থানায় এনে আটক রাখার সত্যতা মেলেনি বলে উল্লেখ করা হয়। ২০১৮ সালের ২৪ জানুয়ারি তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা শেষে মহামান্য হাইকোর্ট জনি নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় থানায় সাধারণ ডায়েরী নিয়ে তার তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেওয়ার জন্য থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এমদাদুল হক শেখ, ফিরোজ হোসেন মোল্লা ও উপ-পরিদর্শক হিমেল হোসেনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা গ্রহণ ও একইসাথে তাদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করা যেতে পারে বলে এক আদেশে উল্লেখ করেন।

সে অনুযায়ি আইন ও শালিস কেন্দ্রের সহযোগিতায় জেসমিন নাহার রেশমা আদালতে মামলা করার প্রস্তুতি নিলে শেষ পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট আইনজীবী অপারগতা প্রকাশ করায় আর মামলা করা হয়নি। এর কয়েক মাস পর জেসমিনের অন্যত্র বিয়ে হয়ে যাওয়ায় মাহামান্য হাইকোর্টে বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি খন্দকার দিলিরুজ্জামান এর আদালতে হাজির হয়ে ২৮৩৩/১৭ নং রিট পিটিশনে শেখ আব্দুর রাশেদ নিজেকে বাদি শ্রেণীভুক্ত হওয়ার আবেদন করেন।

আদালত তা মঞ্জুর করলে শেখ আব্দুর রাশেদ মামলা করার জন্য সাতক্ষীরা জেলা আইনজীবী সমিতির তৎকালিন সভাপতি এড. এম শাহ আলম ও সাতক্ষীরা আদালতের লিগ্যাল এইডের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিচারক সালমা আক্তারের শরণাপন্ন হন। এরপরও কোন আইনজীবী না পাওয়ায় তিনি মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান বিশিষ্ঠ মানবাধিকার কর্মী এড. সুলতানা কামালের দ্বারস্ত হন।

একপর্যায়ে তারই সহায়তায় সাতক্ষীরার জ্যেষ্ট আইনজীবী এড. মোসলেমউদ্দিন ও এড. মোঃ ফরহাদ হোসেনের মাধ্যমে মঙ্গলবার সাতক্ষীরার মুখ্য বিচারিক হাকিমের আদালতে এ মামলা দায়ের করেন। মামলায় সদর থানার তৎকালিন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এমদাদ হোসেন, ফিরোজ হোসেন মোল্লাহ ও উপ-পরিদর্শক হিমেলকে আসামি করা হয়েছে। সাংবাদিক কল্যাণ ব্যাণার্জি, সাংবাদিক এড. আবুল কালাম আজাদ ও সাংবাদিক রঘুনাথ খাঁসহ ২২ জনকে এ মামলায় সাক্ষী শ্রেণীভুক্ত করা হয়েছে। ধারা ৩৬৪/৩০২/১২০/১৬৬/৩৪/১১৪ পিসি।

প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের পহেলা অক্টোবর উপ-পরিদর্শক হিমেল হোসেনের বিরুদ্ধে সাতক্ষীরায় বিভাগীয় মামলা(৬/১৮) দায়ের করা হয়। এ ঘটনায় ২০১৮ সালের ১৮ নভেম্বর সাতক্ষীরার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইলতুৎ মিশের কাছে ও ২২ নভেম্বর খুলনার সহকারি পুলিশ সুপার আব্দুল কাদের বেগ এর কাছে জেসমনি নাহার রেশমা, তার শ্বশুর আব্দুর রাশেদ, শ্বাশুড়ি আনোয়ারা খাতুন সাক্ষী দেন।

একইভাবে ২৮ নভেম্বর মানবাধিকার কর্মী রঘুনাথ খাঁ ও তিন পুলিশ সদস্যের সাক্ষী গ্রহণ করা হয়। একই ঘটনায় ১৬/২০ ও ১৭/২০ বিভাগীয় মামলা হয় তৎকালিন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এমদাদ শেখ ও ফিরোজ হোসেন মোল্লার বিরুদ্ধে। খুলনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ওয়াসিম ফিরোজ ২০২০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর থেকে কয়েক দফায় সাতক্ষীরা আদালতের পুলিশ পরিদর্শকের কার্যালয়ে ও খুলনা নিজ কার্যালয়ে নিখোঁজ ডাঃ জনির বাবা, মা, বোন, চাচা, মানবাধিকার কর্মী রঘুনাথ খাঁ, সিপাহী ফসিয়ার রহমান, সিপাহী ইলিয়্সা হোসেন, সিপাহী মহিদুল ইসলাম ও উপপরিদর্শক রইচউদ্দিনসহ ১৬ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন।

মামলার বাদিপক্ষের আইনজীবী সাতক্ষীরা জজ কোর্টের জ্যেষ্ট আইনজীবী মুক্তিযোদ্ধা এড. মোসলেমউদ্দিন ও এড. ফরহাদ হোসেন বলেন, আজ বুধবার আদালত এ মামলার আদেশ দেবেন।