ভ্যাকসিন কুটনীতিতে পিছিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ!
সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে একটি সংবাদ বেশ চাউর হয়েছে। তা হলো টিকা প্রাপ্তি নিয়ে নিবন্ধন এবং নিবন্ধনের লাইনে থাকা মানুষের উদ্বেগের কথা। সেই উদ্বেগে ঘি ঢেলেছে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট এর করোনা ভ্যাকসিন রপ্তানি সাময়িক স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফর নিয়ে দেশের ভেতরকার বিক্ষোভ কি সেই আগুনে নতুন করে ঘি ঢালবে কি না সেই প্রশ্নের উত্তর পরে খুজলেও চলবে। আপাতত চলুন দেখে নেই দেশের ভেতরকার করোনা ভ্যাকসিন প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি এবং ব্যবস্থাপনা নিয়ে কর্তৃপক্ষ কি ভাবছে সে বিষয়ে ।
ভারত সরকারের দেওয়া উপহার হিসেবে পাওয়া ২০ লাখ করোনা ভ্যাকসিন দিয়ে শুরু হয়েছিল বাংলাদেশের ভ্যাকসিন ভিত্তিক করোনা মোকাবেলা। এরপর বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের সাথে সেরাম ইনস্টিটিউটের চুক্তির আওতায় দুই দফায় আরো ৫০ লাখ করোনা ভ্যাকসিন বাংলাদেশে আসে। সর্বশেষ মোদির সফরের সময় তার সঙ্গে আসা ১০ লাখ করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে মোট ৯০ লাখ ভ্যাকসিনই এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ভরসা। এর মধ্যে ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ হিসেবে ৫৫ লাখের মত করোনা ভ্যাকসিন পুশ করতে সক্ষম হয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। পাইপলাইনে আবেদন বাকি আছে এখনো প্রায় ১২ লাখ মানুষের। এরই মধ্যে করোনা ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার সময়ও ঘনিয়ে আসছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ঘোষণা অনুযায়ী আগামী ৮ এপ্রিল থেকে করোনা ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার কথা। এরই মধ্যে সেরাম ইনস্টিটিউটের ভ্যাকসিন রপ্তানি বন্ধের ঘোষনায় গভীর উদ্বেগে আছে দেশের মানুষ, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
করোনা ভ্যাকসিন প্রাপ্তি নিয়ে দেশের মানুষকে আবারো আশার বানী শুনিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। তিনি বলেছেন সময়মত সেরাম ইনস্টিটিউট করোনার ভ্যাকসিন সরবরাহ না করলে ভিন্ন ব্যবস্থায় ভ্যাকসিন আনা হবে।
কিন্তু বাস্তবতা হলো একমাত্র সেরাম ইনস্টিটিউট ছাড়া সরকারি বেসরকারি কোনো পক্ষই বিকল্প কোনো উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে আনুষ্ঠানিক চুক্তি করেনি। এই অবস্থায় কি বলছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর?
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, একদিকে যথাসময়ে করোনা ভ্যাকসিন না পাওয়া অন্যদিকে প্রাপ্ত ভ্যাকসিন সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা না করতে পারায় সঙ্কটময় পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ফলে টিকা ভিত্তিক সংক্রমন মোকাবেলায় যে প্রস্তুতি সরকারে ছিল তা খানিকটা হুমকির মুখে পড়তে যাচ্ছে। তাহলে এখান থেকে বের হওয়ার উপায় কি? তার কোনো সদুত্তর দিতে পারছে না দেশের স্বাস্থ্য বিভাগ।
বৈশ্বিক করোনা মহামারি মোকাবেলায় শুরু থেকেই টিকা প্রাপ্তি নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের বক্তব্য ছিল সবার আগেই করোনা ভ্যাকসিন পাবে বাংলাদেশ। ২৭ জানুয়ারি ভারতের পক্ষ থেকে উপহার হিসেবে দেওয়া ভ্যাকসিন প্রয়োগের মাধ্যমে ভ্যাকসিন কূটনীতিতে এগিয়েও ছিল বাংলাদেশ। কিন্তু সম্প্রতি দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশে করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কা সামলাতে ভ্যাকসিন কূটনীতিতি এগিয়ে গেছে পার্শ্ববর্তী দেশগুলো। কারন তারা প্রত্যেকে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের পাশাপাশি রাশিয়া এবং যুক্তরাজ্য-যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদন এবং সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি শেষ করে ফেলেছে। যেখানে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ।
তাছাড়া গেলো নভেম্বর থেকে দেশের অভ্যন্তরে সংক্রমনের মাত্রা ক্রমান্বয়ে কমে আসা এবং বিনোদন, পর্যটনসহ রাজনৈতিক কর্মসূচীর ওপর থেকে অলিখিতভাবে সব ধরনের নিষেধাঙ্গা তুলে নেওয়ায় সংক্রমনের ঝুকি যে বাড়তে পারে সে ব্যাপারে জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটি পূর্বাভাস দিয়েই রেখেছিল। কিন্তু সংক্রমনের মাত্র টানা প্রায় তিন মাস ৫ শতাংশের নীচে থাকায় সরকার কিছুটা হাফ ছেড়ে বেঁচে ছিলেন। ইউরোপ আমেরিকায় করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সামলাতে যখন নতুন করে বিধিনিষেধ কঠোরভাবে আরোপ করতে শুরু করলো, তখন বাংলাদেশ সবকিছু উন্মুক্ত করে দিলো। শুরু হলো নিউ নরমাল লাইফ নামের এক ফর্মূলা।
ফলাফল যা হবার তাই, লন্ডন থেকে আকাশপথে দেশের মাটিতে চলে আসলো করোনা ভাইরাসের থার্ড স্ট্রেইন। উচ্চ সংক্রমনের এই করোনা ভাইরাস পর্যটন এলাকা ঘুরে ছড়িয়ে পড়লো সারাদেশে। তখন আবার শুরু হলো স্বাধীনতার সূবর্ণ জয়ন্তী উৎসব। আর সেখানেই আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে যোগ দিতে দেশে আসলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। আর তাকে ঠেকাতে দেশের কিছু নতুন ধর্মভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম শুরু করলো মোদি বিরোধী বিক্ষোভ। দেশ মাতলো উৎসবের আমেজে। শুরু হলো করোনা সংক্রমন বৃদ্ধি। যা এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রনের বাইরে যাওয়ার মত অবস্থায়।
চলুন দেখা যাক স্বাধীনতা সূবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফরকে ঘিরে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া উত্তেজনাকর পরিস্থিতি কতটুকু ভ্যাকসিন কূটনীতিতে প্রভাব ফেলতে পারে সেটা জানার চেস্টা করি।
করোনা মোকাবেলায় শুরু থেকেই বাংলাদেশের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ভারতের ক্ষমতাসীন সরকার। শুরু থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দেশের আলেম সমাজের বিক্ষোভ প্রদর্শনের আগ পর্যন্ত সবকিছুই চলছিল ঠিকঠাক। হঠাৎ কেন পাল্টে গেলো দৃশ্যপট। এর প্রেক্ষিতে কয়েকটি বিষয় আলোচনায় আসতে পারে
১. বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশের প্রধামন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার দেশের মানুষের জন্য ভ্যাকসিন নিশ্চিত করতে বেশি নজর দেবেন।
২. তিস্তা ইস্যুতে সম্প্রতি চীনা বিনিয়োগ সম্ভাবনা ভারতের জন্য হুমকি হতে পারে ভেবে ভ্যাকসিন নিয়ে বাংলাদেশকে চাপে রাখতে পারে ভারত।
৩. ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলের ওপর বাংলাদেশের সাথে ভ্যাকসিন কূটনীতিকে সামনে নিয়ে আসতে পারে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার।
৪. ভ্যাকসিনের মূল্য বাড়াতে সচেস্ট হতে পারে সেরাম ইনস্টিটিউট। এবং
৫. বাংলাদেশের উন্নয়নে কিছুটা মন্থর গতি আনতে সচেস্ট থাকতে পারে প্রতিবেশী শক্তিশালী দেশসমূহ।
যদি তাই হয়, তাহলে এখান থেকে বের হওয়ার উপায় কি? উত্তর একটাই অভ্যন্তরীন সক্ষমতা বৃদ্ধি। করোনা মোকাবেলা সর্বোত্তম পদ্ধতি জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে বাধ্য করা এবং সর্বোচ্চ কূটনীতি ব্যবহার করে বিকল্প উৎস থেকে করোনা ভ্যাকসিন প্রাপ্তি নিশ্চিত করা। পাশাপাশি বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার মধ্যস্ততায় যত দ্রুত সম্ভব দেশের সব প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য করোনা ভ্যাকিসন প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে আরো বেশি কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি করার বিকল্প নেই সরকারের সামনে।