আজ ইস্টার সানডে
খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারীদের অন্যতম একটি উৎসব ‘ইস্টার সানডে’। আজ ৪ এপ্রিল রোববার পুরো পৃথিবীতে অত্যন্ত আনন্দ উদ্দিপনার মধ্যদিয়ে দিনটি উদযাপন করবেন খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা। খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারীরা বিশ্বাস করেন, গুড ফ্রাইডে অর্থাৎ প্রভু যীশুর ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণের পর ঠিক তিনদিনের মাথায় যিশুখ্রিষ্টের পুনরুত্থান হয়েছিল অর্থাৎ তিনি পুনরায় বেঁচে উঠেছিলেন। তাই, তাঁর বেঁচে ওঠা তথা পুনরুত্থানের অলৌকিক ঘটনাটিকে স্মরণ করার জন্যই পালিত হয় এই উৎসব।
পুনরুত্থান পার্বণটি একটি রোববারে পালন করা হয় বলে এর আরেক নাম পুণ্য রোববার বা 'ইস্টার সানডে'।
তাহলে চলুন এই উৎসব ও এর ইতিহাস সম্পর্কে কিছুটা জেনে নেওয়া যাক।
ইতিহাস বাইবেলের নববিধান বা নিউ টেস্টামেন্ট অনুসারে, রোমান কর্তৃপক্ষ প্রভু যিশুকে গ্রেপ্তার করেন এবং তাঁকে ক্রুশবিদ্ধকরণের জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। এর পিছনে কারণ হল যিশুখ্রিষ্ট নিজেকে 'ঈশ্বরের পুত্র' বলে উল্লেখ করেছিলেন। তাই, তাঁকে ঈশ্বরনিন্দার অভিযোগে অভিযুক্ত অপরাধী এবং মৃত্যুর যোগ্য বলে বিবেচনা করা হয়েছিল। প্রভু যিশুর অন্যতম শিষ্য জুডাস রৌপ্য মুদ্রার জন্য যিশুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। সে প্রভুকে গ্রেপ্তারের জন্য রোমান কর্তৃপক্ষকে যিশুখ্রিষ্টের বিষয়ে সমস্ত তথ্য দিয়েছিল এবং সাহায্য করেছিল। ফলস্বরূপ, প্রভু যিশুখ্রিষ্টকে গ্রেপ্তার করে ক্রুশে দেওয়া হয়। কিন্তু মশীহ-এর ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে, 'খ্রিষ্ট দুঃখভোগ করিবেন, এবং তৃতীয় দিনে মৃতগণের মধ্য হইতে উঠিবেন।' প্রভু যিশুখ্রিষ্টও তাই করেছিলেন।
‘ইস্টার’ শব্দটি এসেছে জার্মান প্যাগান ধর্মের দেবী ‘ইয়োস্ত্রে’ থেকে। তিনি ছিলেন নবজন্ম এবং উর্বরতার দেবী, ছোট খরগোশ এবং ডিম ছিল তার প্রতীক। বাইবেলের নতুন নিয়ম অনুযায়ী, কালভেরি পর্বতে ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মারা যান যিশু। মৃত্যুর ঠিক তিনদিন পর ছিল রোববার, আর সেই পবিত্র দিনে পুনরুত্থান হয় যিশুর। মৃত্যু থেকে পুনরায় জীবিত হয়ে স্বর্গে ফিরে যান তিনি। বলা হয়, যিশুখ্রিস্টের পুনরুত্থান কিংবা নবজন্মকে স্মরণ করার জন্য এই বিশেষ দিনটির নামকরণ করা হয়েছে দেবী ‘ইয়োস্ত্রে’র নাম অনুসারে।
মানবজাতির জন্য যিশুর এই আত্মত্যাগ স্মরণ করতে ইস্টারের ৪৫ দিন আগে থেকে শুরু হয় একটি বিশেষ কর্মসূচি, যাকে বলা হয় প্রায়শ্চিত্তকাল। প্রায় ছয় সপ্তাহের এই সময়ে রোববার দিন বাদে প্রতিদিন নানাভাবে নিজের পাপের জন্য অনুতাপ প্রার্থনা করে খ্রিস্টানরা। উপবাস রাখা, নিয়মিত প্রার্থনা আর পাপস্বীকারের মাধ্যমে পালিত হয় প্রায়শ্চিত্তকাল।
রোববার বাদে উপবাস রাখার এই কর্মসূচি চলে ৪০ দিন। এছাড়া প্রায়শ্চিত্তকাল চলাকালীন প্রতি শুক্রবার বিশেষভাবে প্রায়শ্চিত্ত করে খ্রিস্টানরা। কারণ বাইবেলের মতে, যিশুর মৃত্যু হয়েছিল শুক্রবারে ঠিক দুপুর তিনটায়। ইস্টার সানডের আগের শুক্রবার তাই বেশ ঘটা করে পালিত হয় ‘গুড ফ্রাইডে’। অনেকে এই দিনকে ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’ কিংবা ‘গ্রেট ফ্রাইডে’ বলে থাকেন। কালো পোশাক পরে সেদিন যিশুখ্রিস্টের মৃত্যুর শোক অনুভব করতে খ্রিস্টানরা সমবেত হন গির্জায়, চলে বিশেষ প্রার্থনা।
তবে বড়দিনের মতো ইস্টার সানডে কিন্তু নির্দিষ্ট কোনো তারিখে পালিত হয় না। বলা হয়, ২১ মার্চের পর যখন আকাশে প্রথম দেখা যায় পূর্ণ চাঁদ, তার পরের রোববার পালন করা হয় ইস্টার। মূলত গ্রেগরিয়ান এবং জুলিয়ান ক্যালেন্ডারসহ বেশ কয়েকটি দিনপঞ্জিকার হিসেব মিলিয়ে বের করা হয় ইস্টারের তারিখ, যা ৪ এপ্রিল থেকে ৮ মের মধ্যে যে কোনো সময় হতে পারে।
পুনরুত্থানের এই পার্বণটি খ্রিস্টানদের জন্য এক দীর্ঘ ধর্মীয় পর্বের শেষ বা চূড়ান্ত পর্যায়। ইস্টারের আগের বিশ্বের বহু ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টান, যিশুর উপবাসের অনুকরণে ৪০ দিনব্যাপী প্রার্থনা ও উপবাস করেন। বাৎসরিক এই উপবাস পর্বটি একটি বুধবারে শুরু হয়, যাকে ইংরেজিতে অ্যাশ ওয়েডনেসডে (Ash Wednesday) বলে ডাকা হয়। উপবাস পর্বটি সমাপ্ত হয় পুণ্য শনিবার, অর্থাত্ ইস্টার সানডের আগের দিন। উপবাসের শেষের সপ্তাহটিকে পবিত্র বা পুণ্য সপ্তাহ নাম দেওয়া হয়েছে। এই সপ্তাহের বৃহস্পতিবারটি হল মন্ডি থার্সডে (যা যিশুর লাস্ট সাপারকে চিহ্নিত করে), গুড ফ্রাইডে ( ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার দিন)। পুনরুত্থান পার্বণ একটি ররিবার পালিত হলেও এর সংশ্লিষ্ট ধর্মীয় পর্বটি আরও আটটি রবিবার পর্যন্ত বজায় থাকে।
ইস্টারের দিনক্ষণ নিয়ে শুরুর দিকে নানা মত প্রচলিত ছিল। ‘স্প্রিং ইকুইনক্স’ বা মহাবিষুব-এর সময় এই উৎসব পালন করা হত। যিশুর ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার বছর নিয়েও মতান্বর রয়েছে। দুটি মতবাদ অনুসারে ৩৩ খ্রিস্টাব্দে ক্রুশবিদ্ধ হন। তবে স্যার আইজাক নিউটন গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধি মেপে সময়টাকে ৩৪ খ্রিস্টাব্দ বলে দাবি করেছিলেন।
এখন পশ্চিম ইউরোপের চার্চগুলি এই দিন স্থির করে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার মেনে, আর পূর্ব ইউরোপে অনুসরণ করা হয় জুলিয়ান ক্যালেন্ডার। মূলত খ্রিস্টানের উত্সব হলেও ওল্ড টেস্টামেন্ট অনুসারে, ইহুদীদের উত্সব পাসওভার এবং মিশরীয় জিউ সম্প্রদায়ের মানুষের এক্সোডাস উত্সবের সঙ্গেও ‘ইস্টার’-এর যোগ রয়েছে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেভাবে উদযাপন করা হয় ‘ইস্টার সানডে’-
ইস্টারের একটি বড় আকর্ষণ হল, ‘ইস্টার এগ’ বা ‘ইস্টারের ডিম’। ডিমকে ধরা হয় নতুন জীবনের প্রতীক হিসেবে, ঠিক যেমন করে নতুন জীবন পেয়েছেন যিশু।
মুরগির সেদ্ধ করা ডিমের খোলসের উপর তৈরি করা হয় নানা ধরনের নকশা। পেঁয়াজের খোসা, বাদাম, ফুলের পাঁপড়ি থেকে শুরু করে রংতুলি, সুতা-জরি আরও অনেককিছু দিয়ে সাজানো হয় এই ডিমগুলো। দেশ এবং সংস্কৃতি অনুযায়ী এর ব্যবহারও ভিন্ন।
আমেরিকাসহ পৃথিবীর বেশ কয়েকটি দেশে ইস্টারের আগের দিন চলে ডিমে নকশা করার কাজ। বড়দের পাশাপাশি শিশুদের জন্য এটি খুবই মজার একটি খেলা। সারাদিন ডিমে নকশা করার পর রাতের বেলা পরিবারের ছোটরা ঘুমিয়ে পড়লে বড়রা ডিমগুলো লুকিয়ে ফেলেন বাড়ির বিভিন্ন স্থানে। এরপর ইস্টার সানডের সকালে শুরু হয় ডিম খোঁজার প্রতিযোগিতা। সেদ্ধ করা মুরগির ডিম ছাড়াও এখন পাওয়া যায় চকলেট ডিম এবং প্লাস্টিকের ডিম, যেগুলোতে থাকে নানা ধরনের ক্যান্ডি।
ডিম নিয়ে করা হয় আরও একটি বিশেষ খেলা, যার নাম ‘এগ রোল’। এই খেলায় শিশুরা তাদের নকশা করা ডিমকে লম্বা হাতলওয়ালা একটি চামুচ দিয়ে ধাক্কা দিয়ে সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়, যার ডিম যত দ্রুত পৌঁছাতে পারবে সীমানায়, সেই হবে বিজয়ী।
ইস্টারের পরের দিন আমেরিকার হোয়াইট হাউজের আঙিনায় অনুষ্ঠিত হয় ‘এগ রোল’ খেলা। এছাড়া ইউরোপের অনেক দেশে দেখা যায় এই খেলার প্রচলন। ইস্টার উপলক্ষে ডিম নিয়ে নাচানাচিও করা হয়! মেঝেতে অনেক নকশা করা ডিম ঢালাওভাবে বিছিয়ে তার উপর শুরু হয় নাচ। লক্ষ্য একটাই, ভাঙা যাবে না কোনো ডিম।
‘এগ ড্যান্স’-এর উৎপত্তি মূলত জার্মানিতে, কিন্তু সমগ্র ইউরোপে ঐতিহ্যবাহী খেলা হিসেবে অনুষ্ঠিত হয় এটি।
বুলগেরিয়া, গ্রিস এবং সাইপ্রাসের অধিবাসীরা ইস্টারের দিন পরিবারের সদস্যদের গায়ে ডিম ছুড়ে মারেন। ডিম না ভাঙাকে সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে ধরা হয়।
লেবাননে ইস্টারের আগের দিন বাড়িতে সাজিয়ে রাখা হয় নকশা করা ডিমগুলো। ইস্টারের দিন বাড়ির বাচ্চারা সেই ডিম ভেঙে খায় এবং বিশ্বাস করে যিশু পুনরায় জীবন ফিরে পেয়েছেন।
চেক প্রজাতন্ত্র এবং স্লোভাকিয়াতে ইস্টারের পরের দিন চলে পানি খেলা। সকালবেলা একটি বিশেষ কঞ্চির সাহায্যে পছন্দের নারীর গায়ে আলতোভাবে আঘাত করেন পুরুষেরা, অনেকে ছুড়ে মারেন ঠাণ্ডা পানি।
কথিত আছে, আগামী এক বছরের জন্য নারীদের সৌন্দর্য এবং সুস্বাস্থ্য ধরে রাখতে এই বিশেষ কঞ্চির আঘাত পাওয়া জরুরি! এমনকি কোনো নারীকে যদি আঘাত না করা হয়, তবে তিনি মন খারাপ করেন।
নারীরা রীতি অনুযায়ী পুরুষদের একটি করে ডিম উপহার দেন, যেগুলো তারা নিজের হাতে নকশা করে থাকেন। অথবা তার বাড়িতে দাওয়াত করেন। আর যদি কোনো বাচ্চা আসে, তবে তাকে দেওয়া হয় মিষ্টি কিংবা খুচরো পয়সা। সেদিন বিকেলে নিজেদের প্রতিশোধ নিতে পারেন নারীরা, তখন তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী যে কোনো পুরুষের গায়ে ঠাণ্ডা পানি ঢেলে দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। এছাড়া পোল্যান্ডে চলে দিনব্যাপী পানি খেলা।
‘ইস্টার বানি’ অর্থাৎ ইস্টারের খরগোশ হল অনেকটা সান্তাক্লজের মতো। বলা হয়, ইস্টারের আগের দিন রাতে ঝুড়িতে করে রঙিন ডিমসহ নানা ক্যান্ডি এবং খেলনা নিয়ে শিশুদের বাড়িতে রেখে যায় ইস্টার বানি। উর্বরতার প্রতীক হিসেবে ধরা হয় খরগোশকে। চকলেট ইস্টার বানি বিশ্বব্যাপী খুবই জনপ্রিয় একটি খাবার। তবে ডিম কিংবা খরগোশ, কোনোটির উল্লেখ নেই বাইবেলে।
গুয়াতেমালা এবং ব্রাজিলে ইস্টার উপলক্ষে রাস্তা সাজানো হয় এক ধরনের বিশেষ কার্পেট দিয়ে, যা তৈরি হয় বিভিন্ন রংয়ের ফুলের পাপড়ি এবং কাঠের গুঁড়ি দিয়ে।
ইস্টারের ঠিক ৪৯ দিন আগে অনুষ্ঠিত হয় ব্রাজিলিয়ান কার্নিভাল। ব্রাজিলের বিভিন্ন শহরে বিভিন্নভাবে উদযাপন করা হয় এই উৎসব। প্রতি বছর চারদিনব্যাপী চলে এই উৎসব, এই সময়ে ব্রাজিলে সবচেয়ে বেশি পর্যটকের সমাগম ঘটে।
মূলত প্রায়শ্চিত্তকালের আগমনের শুরুতে সব ধরনের জাগতিক আনন্দকে বিদায় জানানো হয় এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। ইস্টার উপলক্ষে বিশ্বজুড়ে আয়োজন করা হয় নানা ধরনের খাবারের। এর মধ্যে রয়েছে ইস্টারের বিশেষ পাউরুটি, বিস্কুট এবং কেক।
তবে বাংলাদেশে ইস্টার পালন করা হয় আরও ঘরোয়াভাবে। বাংলাদেশে ইস্টারের দিন বাড়িতে অতিথিদের আপ্যায়ন করা হয় দই, চিঁড়া, মুড়ি এবং খই দিয়ে। এছাড়া বড়দিনের মতো ইস্টারেও বাড়িতে কেক এবং পিঠা বানিয়ে থাকেন খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীরা।