ঢাকা-সিলেট চার লেন প্রকল্পের আদ্যপান্ত
অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে অবশেষে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় চূড়ান্ত অনুমোদন পেলো ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক চার লেন প্রকল্প। ১৬ হাজার ৯১৮ কোটি ৫৮ লাখ টাকা ব্যয়ে অনুমোদিত প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ১৩ হাজার ২৪৪ কোটি ৬৮ লাখ টাকা ঋণ দেবে এশিয়ান ডেভলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি)। আর বাকি ৩ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা দিবে সরকার।
মঙ্গলবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) সকালে অনুষ্ঠিত একনেক সভায় প্রধানমন্ত্রী ও একনেক চেয়ারপারসন শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে প্রকল্পটির অনুমোদন দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে গণভবন থেকে এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী-সচিবরা রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসিতে সভায় অংশ নেন।
ঢাকার কাঁচপুর থেকে সিলেটের পীর হাবিবুর রহমান চত্বর পর্যন্ত প্রস্তাবিত সড়কটির দৈর্ঘ্য হবে ২০৯ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। প্রকল্পটির বাস্তবায়ন করবে সরকারের সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ)। প্রকল্পটি ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বাস্তবায়ন করবে সংস্থাটি।
ইতোমধ্যে ঢাকা-সিলেট চার লেন প্রকল্প নিয়ে কম জল ঘোলা হয়নি। সড়কটি চার লেনে উন্নীত করতে কখনো চীনের টাকায়, কখনো এডিবির টাকা, আবার কখনো রাষ্ট্রীয় কোষাগারের টাকায় বাস্তবায়নের আলোচনা থাকলেও শেষ পর্যন্ত এডিবির ঋণেই বাস্তবায়ন হচ্ছে প্রকল্পটি।
প্রকল্পটিতে মূল সড়কের উভয় পাশে ধীরগতির যান চলাচলের জন্য আলাদা সার্ভিস লেন নির্মিত হবে। বাঁক সরলীকরণসহ অধিকমাত্রার ট্রাফিক বিবেচনায় এনে ৮০ কিলোমিটার গতিবেগ নিশ্চিত করা হবে। শিল্প ও বাণিজ্যে গতিশীলতা আনতে এশিয়া হাইওয়ে নেটওয়ার্ক, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাত দেশের জোট ‘বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন (বিমসটেক) করিডোর, দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) করিডোরসহ আঞ্চলিক সড়ক নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণে চারলেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে সংশ্লিষ্টদের অভিমত।
উপ-আঞ্চলিক যোগাযোগ বিশেষ করে ভারত, মিয়ানমার, নেপাল, ভুটান এবং চীনের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ভৌগলিকভাবে বাংলাদেশ কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। এসব বিবেচনায় প্রকল্পটি বিশেষভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। চারলেন বিশিষ্ট মহাসড়কের উভয়পাশে ধীরগতির যান চলাচলের জন্য ৫ দশমিক ৫ মিটার প্রশস্ত করাসহ প্রকল্পের আওতায় সড়ক নির্মাণে অতিরিক্ত ৯৮৬ দশমিক ৪৭ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হবে। এজন্য মোট ব্যয় হবে চার হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। ভূমি অধিগ্রহণে কাঁচপুর থেকে সিলেট পর্যন্ত ইউটিলিটিও স্থানান্তর করা হবে, নির্মাণ করা হবে ৩২১টি আরসিসি কালভার্ট। কালভার্টগুলোর মোট দৈর্ঘ্য হবে প্রায় এক হাজার ৩৮১ মিটার। ছোট-বড় ৭০টি ব্রিজসহ থাকবে ৭টি ফ্লাইওভার/ওভারপাস, ৬টি রেলওয়ে ওভারপাস।
ঢাকা (কাঁচপুর) থেকে সিলেটের মোট দূরত্ব ২২৩ দশমিক ১২৮ কিমি। এর মধ্যে ১১ দশমিক ৫৬ কিলোমিটার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ থেকে বিশ্বরোড পর্যন্ত। এর উন্নয়ন এলওসির আওতায় বাস্তবায়িত হচ্ছে এবং ২ দশমিক ৩৪ কিলোমিটার দীর্ঘ ভৈরব ব্রিজ বাদ দেওয়া হয়েছে। ফলে প্রস্তাবিত সড়কের মোট দৈর্ঘ্য দাঁড়িয়েছে ২০৯ দশমিক ৩২৮ কিলোমিটার।
এরআগে সড়কসচিব নজরুল ইসলামকে ঘুষ সাধার অভিযোগে চীনা রাষ্ট্রীয় কোম্পানি চায়না হারবারকে কালো তালিকাভুক্ত করে সরকার। ফলে এই প্রকল্প থেকে ছিটকে পড়ে চীন। আর সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে বিশাল অঙ্কের প্রকল্পটি নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়নের ঝুঁকি নিতে চায়নি সরকার।
তিন বছর আগে প্রাথমিকভাবে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে প্রাথমিক ব্যয় ধরেছিল ৯ হাজার ৫১০ কোটি টাকা। পরে চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি এই প্রকল্পের ব্যয় সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করে। নানা জটিলতায় গত তিন বছর কোনো অগ্রগতি না হওয়ার পাশাপাশি দর পরিবর্তন হয়ে যাওয়ায় প্রকল্পটির ব্যয় সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা থেকে এক লাফে ১৭ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়।
নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, নির্মাণ তদারকিতে পরামর্শক, পুনর্বাসনকাজে পরামর্শক, আয় ও জীবিকার জন্য পরামর্শক, প্রকল্পটি বাস্তবায়নে পরামর্শকসহ ভিন্ন ভিন্ন নামে পরামর্শক খাতে এই প্রকল্পে মোট ব্যয় ধরা হয় ৩২৪ কোটি টাকা। দেশের মধ্যে চার লেনের একটি সড়ক নির্মাণ করতে কেন আলাদা পরামর্শকের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল, তা নিয়ে সে সময় আপত্তি তোলে পরিকল্পনা কমিশন। পরামর্শক খাতের এই ব্যয়কে বর্তমান বাস্তবতায় অনেক বেশি বলে মনে করে কমিশন।
এছাড়া প্রকল্পটির তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রকল্পের আওতায় ১০টি জিপ গাড়ি কেনার জন্য প্রতিটি জিপ ৯৫ লাখ টাকা ধরে ১০টি জিপ কেনার মোট খরচ ধরা হয় ৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা। সেইসাথে প্রকল্পের আওতায় ৮টি পিকআপ কেনার জন্য প্রতিটি ৫৮ লাখ টাকা ধরে মোট খরচ ৪ কোটি ৬৪ লাখ টাকা ধরা হয়। করোনার সময়ে কেন ১০টি জিপ গাড়ি কিনতে হবে, তা নিয়েও আপত্তি তোলে পরিকল্পনা কমিশন।
শুধু তাই নয় সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, ঢাকা-সিলেট সড়কটি চার লেনে উন্নীত করতে গিয়ে ছোট–বড় মোট সেতু বানাতে হবে ৬৪টি। যার মোট দৈর্ঘ্য ৫ হাজার ৭০১ মিটার। এসব সেতু বানাতে খরচ দেখানো হয়েছে ২ হাজার ৭২২ কোটি টাকা। ছোট–বড় ৩০৯টি কালভার্ট নির্মাণে ব্যয় হবে ৬৪০ কোটি টাকা। পরিকল্পনা কমিশন বলছে, যেসব সেতু ও কালভার্ট নির্মাণের কথা বলা হয়েছে, তাতে এখনো নকশাই তৈরি হয়নি। এ ছাড়া এ প্রকল্পের আওতায় উড়ালসড়ক, ওভারপাস, রেল ওভারব্রিজ, ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণে খরচ হবে ১ হাজার ৬১৩ কোটি টাকা। রেল মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে তবে রেল ওভারব্রিজ নির্মাণের পরামর্শ দেওয়া হয় সড়ক ও পরিবহন মন্ত্রণালয়কে।
তথ্য–উপাত্ত বলছে, এ প্রকল্পের আওতায় মাটির কাজ করার জন্য আলাদাভাবে ১ হাজার ৬৬৪ কোটি টাকা রাখা হয়েছে। কিন্তু কিসের ওপর ভিত্তি করে এই টাকা রাখা হয়েছে সেটাও মন্ত্রণালয়ের কাছে জানতে চায় কমিশন। বিস্তারিত সমীক্ষার ওপর ভিত্তি করে তবে মাটির কাজে খরচ নির্ধারণের তাগিদ দেওয়া হয় পরিকল্পনা কমিশন থেকে।
সর্বশেষ প্রকল্পের সারসংক্ষেপ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে- সাত ধরনের পরামর্শকের জন্য মোট ব্যয় ৩৫৩ কোটি ৯৮ লাখ টাকা ধরা হয়েছে। এর মধ্যে নির্মাণ তদারকির জন্য পরামর্শক খাতে ২৭১ কোটি ৪৮ লাখ টাকা ধরা হয়। পুনর্বাসন কাজে পরামর্শক সেবায় (আইএনজিও) ৬ কোটি ২৯ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়। আয় ও জীবিকার জন্য পরামর্শ সেবায় (এনজিও) দুর্বল জনগোষ্ঠীর জন্য পুনরুদ্ধার প্রোগ্রামে ১ কোটি ৯৮ লাখ ৬৯ হাজার টাকা ধরা হয়। অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কার্যক্রমের জন্য সিএ ফার্ম ৮০ লাখ টাকা, রাস্তা সুরক্ষার জন্য মূল্য সংযোজন পরামর্শক সেবায় ১২ কোটি ৭৫ লাখ টাকা এবং সেফগার্ড অ্যাকটিভিটিসের জন্য পরামর্শক সেবায় ৩৯ কোটি ৪২ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে।
প্রকৌশল নিউজ/এস