ব্যাপক বৈশ্বিক সমর্থন সরকারের কূটনৈতিক সাফল্য : তৌহিদ
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি ব্যাপক আন্তর্জাতিক সমর্থনকেই সরকারের সার্বিক কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবে অভিহিত করেছেন।
তিনি বাসস’কে বলেন, ‘দায়িত্ব গ্রহণ করার পর, আমরা সব দেশের সাথে যোগাযোগ করে ব্যাপক ইতিবাচক সাড়া পেয়েছি।’ অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর, আন্তর্জাতিক মহল থেকে বিদেশী দূতগণ কীভাবে এ সরকারকে স্বীকৃতি দেন এবং এ সরকারের প্রতি সংহতি ও নিঃশর্ত সমর্থন প্রকাশ করেন, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তা তুলে ধরেন।
গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে।
প্রফেসর ইউনূসের বৈশ্বিক মর্যাদা বাংলাদেশের কূটনৈতিক ভাবমূর্তিকে শক্তিশালী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তাঁকে আন্তর্জাতিক মহলের সাদরে স্বাগত জানানোই এর প্রমাণ। তৌহিদ বলেন, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার উদ্যোগ ব্যাপকভাবে সমর্থিত হয়েছে। প্রফেসর ইউনূস নিউইয়র্ক ও বাকুতে অন্যতম প্রধান দু’টি বৈশ্বিক সম্মেলনে উষ্ণ অভ্যর্থনা পেয়েছেন- যা বৈশ্বিক মঞ্চে বাংলাদেশের অবস্থানকে দৃঢ় করেছে।
তৌহিদ বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণাসহ চ্যালেঞ্জগুলোও স্বীকার করে জোর দিয়ে বলেন, সত্য ও স্বচ্ছতা বিজয়ী হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কূটনৈতিক অর্জনগুলোর মধ্যে একটি হল আগস্ট-জুলাই মাসে বাংলাদেশে ছাত্র-নেতৃত্বাধীন গণঅভ্যুত্থানের সাথে মিলিত প্রতিবাদে অংশ নেওয়ার জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাতে (ইউএই) আটক শতাধিক বাংলাদেশী প্রবাসীকে মুক্তি দেওয়া।
প্রাথমিকভাবে সংযুক্ত আরব আমিরাতের ফেডারেল আদালতে এদের দীর্ঘ কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। পরে প্রধান উপদেষ্টা ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট মধ্যে সরাসরি আলোচনাসহ উচ্চ-স্তরের কূটনৈতিক যোগাযোগের পর, বন্দীদের ক্ষমা করে দেশে পাঠানো হয়।
এ ঘটনাকে বিশ্বে অধ্যাপক ইউনূসের সুখ্যাতি ও সরকারের কৌশলগত যোগাযোগ এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে এ বিক্ষোভ হয়েছে বলে সে দেশের সরকারকে বোঝানোর প্রচেষ্টাকে কৃতিত্ব দিয়ে তৌহিদ বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা নজিরবিহীন।’
তৌহিদ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের সমাপ্তি এবং অবসর-পরবর্তী রাষ্ট্রদূতদের মেয়াদ না বাড়িয়ে জুনিয়র কর্মকর্তাদের পদোন্নতির পথ প্রশস্ত করাসহ শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘প্রশাসনিক জঞ্জাল পরিষ্কার ও দক্ষতার উন্নতির লক্ষ্যেই এ পদক্ষেপগুলো নেওয়া হয়েছে।’
তৌহিদ প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মধ্যে বৈঠককে একটি মাইলফলক বলে বর্ণনা করেছেন। এটি ৩০ বছরের মধ্যে দুই দেশের নেতাদের মধ্যে প্রথম উচ্চ-পর্যায়ের বৈঠক। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো কোনও মার্কিন প্রেসিডেন্ট জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ফাঁকে বাংলাদেশ সরকার প্রধানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
বৈঠকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকে তার দেশের পূর্ণ সমর্থনের কথা জানিয়েছেন, যাকে একটি ‘বিরল ঘটনা’ হিসাবে দেখা হয়।
এছাড়া, পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের সঙ্গে আর্থিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার জন্য যুক্তরাষ্ট্র একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল পাঠায়। ১৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের অন্তর্র্বর্তী সরকারের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২০০ মিলিয়ন সহায়তা প্যাকেজের ঘোষণা দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন
ইইউ’র উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি জোসেপ বোরেল বাণিজ্য, সুশাসন ও মানবাধিকার বিষয়ে সহযোগিতার ওপর গুরুত্বারোপ করে গণতান্ত্রিক নির্বাচন ও সংস্কারের প্রতি তাদের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছেন। ইইউ বছরে ২৪ বিলিয়ন ডলারের বাংলাদেশি পণ্য আমদানি করে।
এদিকে, অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রতি সমর্থন এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা জোরদারের লক্ষ্যে ঢাকা ও নয়াদিল্লিতে অবস্থানরত ২৭টি ইউরোপীয় দেশের প্রতিনিধিত্বকারী কূটনীতিকরা ড. ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন।
যুক্তরাজ্য
ইন্দো-প্যাসিফিক বিষয়ক ব্রিটিশ মন্ত্রী ক্যাথরিন ওয়েস্টের ঢাকা সফরকালে তিনি অন্তর্র্বর্তী সরকারের সংস্কার উদ্যোগ সমর্থনে যুক্তরাজ্যের প্রতিশ্রুতি তুলে ধরেন। তৌহিদ বলেন. ‘তারা সহযোগিতা করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন এবং যুক্তরাজ্য কীভাবে অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারকে সহায়তা করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চেয়েছেন।’
চীন
‘পূর্ববর্তী সব সরকার চীনের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছে এবং আমরা এটি অব্যাহত রাখাবো’ উল্লেখ করে তৌহিদ বলেন, পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সরকারের সম্পৃক্ততা বেইজিংয়ের সঙ্গে সম্পর্ককে প্রভাবিত করবে না। দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা জোরদার এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছে চীন।
ভারত
তৌহিদ বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলো কাটিয়ে উঠতে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়ে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন ‘আমরা ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ককে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি এবং আমি বিশ্বাস করি এটি ভারতের জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ।’
আগামী মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠেয় বাংলাদেশ-ভারত ফরেন অফিস কনসালটেশনের (এফওসি) কথা উল্লেখ করে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, এফওসি হবে সেক্ষেত্রে দিকে প্রথম পদক্ষেপ।’ তিনি বলেন, ড. ইউনূস এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে টেলিফোন কথোপকথন এবং ইউএনজিএ’র ফাঁকে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে তার বৈঠকসহ দ্বিপক্ষীয় বৈঠক সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্র তৈরি করেছে।
উপদেষ্টা বর্তমান রাজনৈতিক আবহাওয়ায় চ্যালেঞ্জগুলো স্বীকার করে বলেন, ‘কিছু সমস্যা থাকতে পারে - এটি স্বাভাবিক। যখন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়, তখন সমস্যা হতেই পারে। উভয় পক্ষের সুবিধার জন্য এই সমস্যাগুলো কাটিয়ে একটি ভালো কর্ম সম্পর্ক তৈরি করা আমাদের লক্ষ্য। তবে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে পদত্যাগের পর, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে অবস্থান করার কারণে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে বলে স্বীকার করেন তৌহিদ।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে শেখ হাসিনার পদত্যাগে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতির পুনর্মূল্যায়নের দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে, ফলে জোট পুনর্গঠন এবং আঞ্চলিক সম্পর্ক জোরদার করার নতুন সুযোগ তৈরি করেছে।