ফেসবুকে আনন্দ খোঁজা প্রহসনের নামান্তর


নজরুল ইসলাম তোফা :
ফেসবুকে আনন্দ খোঁজা প্রহসনের নামান্তর
  • Font increase
  • Font Decrease

প্রেম, পুলক, উল্লাস, আহ্লাদ, পূর্ণতা, পরিতোষ প্রভৃতি একক, একাধিক বা সম্মিলিত অনুভুতিকে আনন্দ/সুখ বলে। জীববিদ্যা, মনঃস্তত্ত, ধর্ম ও দর্শনে আনন্দের অর্থ কিংবা উৎস উন্মোচনের জন্যে বহুকালব্যাপী প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছে। যদিও আনন্দ/সুখ পরিমাপ করা বেশ কঠিন কাজ, কিন্তু বিজ্ঞানীরা নানান উপায়ে এই দুঃসাধ্য সাধন করার চেষ্টা করেছেন।

জানা যায়, অক্সফোর্ডে আনন্দ কিংবা সুখ বিষয়ক গবেষণায় বহুসংখ্যক বৈশিষ্টের সঙ্গেই আনন্দের সরাসরি সংযোগ শনাক্ত করা হয়েছে। যেমন সামাজিক ক্রিয়া কর্ম কিংবা সম্পর্ক, দাম্পত্য অবস্থান, কার্যক্ষেত্র, স্বাস্থ্য, গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা, আশাবাদ, ধর্মীয় সম্পৃক্ততা, এনডরফিন এবং আয় সহ সুন্দরের সান্নিধ্য।

এবার আসি, 'আনন্দ কিংবা সুখের' পরপরই আসে যেন এক ধরনের অনুভূতি সেটা পরস্পর বন্ধু সমাজ না হলে হয় না। অবশ্য অনেকেই মনে করেন বন্ধুকে তো মনের সব কথা খুলে বলা যায়, বন্ধুত্ব ছাড়া ভালবাসা সম্ভব নয়। আর এমন ধারণা থেকেই প্রিয়তম বন্ধুটিকে অনেকেই জীবনসঙ্গী হিসেবেও বেছে নিতে চান। তাতে কি ঘটে, অনেকেরই বৈবাহিক জীবনে বন্ধু ও বন্ধুত্বাও জানালা দিয়ে পালিয়ে যায়। এমন ঘটনা এখন হরহামেশাই ঘটছে। বিশেষ করে ফেসবুক প্রযুক্তি ব্যবহার করে। বিয়ে পর্যন্ত নিয়েও যাচ্ছে এমন ফেসবুক প্রযুক্তি‌, আর তারপরেই জীবনের অন্য মাত্রা যুক্ত হচ্ছে। পরিপূর্ণ এমন আনন্দের ময়দান হতে যখন প্রিয় বন্ধুকে বিয়ে করে সংসার জীবনে আনন্দ/সুখের ভাটা পড়ে তা খুবই দুঃখজনক।

আধুনিক মানুষের জীবনের সাথে নিবিড়ভাবেই জড়িয়ে আছে ফেসবুক। এমন মাধ্যমকে কেউ অধিকার করতে পারে না। কিন্তু এখানে সম্পর্কটা অনেকটা পারস্পরিক স্বার্থে বাঁধা এমনটাই মনে হয়। একটু পরিস্কার করে বলি- ফেসবুকের মাধ্যমে ভার্চ্যুয়াল বন্ধুত্ব তৈরির সাথে সাথেই ফেসবুক কিন্তু ভার্চ্যুয়াল শত্রুও তৈরি করছে। এ শত্রুতা ভার্চ্যুয়ালের সীমারেখা ছাড়িয়ে প্রায়শই বাস্তবেও ঢুকে যাচ্ছে। এখানে ভার্চ্যুয়াল স্বার্থের লেনদেনের পাশাপাশি ঠকবাজিও চলে অবিরাম। নিঃসঙ্গ মানুষেরা চায় মানুষ তার সঙ্গে যোগাযোগ করুক, কথা বলুক।  এ চাওয়া পাওয়ার লেনদেন চলে ফেসবুকে। বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ায় বন্ধুত্ব-সম্পর্কের হাতছানিটা  অনেকাংশেই যেন 'প্রতারণার জাল কি়ংবা মৃত্যুর ফাঁদ'‌।

যেভাবে বেড়ে যাচ্ছে সাইবার অপরাধ, তাতে এমন প্রশ্ন এখন সবচেয়ে বড়। বন্ধুত্বের আড়ালেই লুকিয়ে থাকে ঘাতকের দল। খুব সহজভাবেই ফেসবুকে অচেনা মুখ, অচেনা মানুষ। সেখান থেকে এখন শুরু হয় 'বন্ধুত্বের পথচলা'। কখনও কখনও সেই সম্পর্কই ক্রমশ কাছে আসছে। গড়েও উঠছে খুবই নিবিড় সম্পর্ক। তাই, ভার্চুয়াল সম্পর্ক থেকে তৈরি হয় 'প্রেম এবং ভালবাসার' সম্পর্ক। সুতরাং ফেসবুকের এ ভার্চুয়াল জগতের মধ্যেই অনেকে ফাঁদ পাতে। প্রতারণার ফাঁদ।

তাদের গভীর বন্ধুত্বকে একসময় প্রেম ভেবে ভুলও করে বসে অনেকে। পরস্পরের পছন্দ-অপছন্দ, ভাল-মন্দের খেয়াল রাখাটাকে অনেকেই ভুলবশত- "অন্ধ ভালবাসা" বলে ধরে নেন। শুধু অন্ধ আকাঙ্খাই নয়। এমন অনেক আকাঙ্খাই শেষ হয়ে যায় ফেসবুকের ফাঁদপাতা ভূবনে। ভালোবাসা, ঘর গড়ার স্বপ্ন সব শেষ। গত কয়েকমাসেই সামনে এসেছে ফেসবুকের মাধ্যমে গড়ে ওঠা নানাভাবে বিভিন্ন সম্পর্কের মর্মান্তিক পরিনতি। বলতে হয় যে, এই চূড়ান্ত অবস্থার ভার্চ্যুয়াল বন্ধু ভার্চ্যুয়াল শত্রুতে পরিণত হয় নিজস্ব কৃতকর্মের ফল। যেহেতু এখন জগৎটাই  ভার্চ্যুয়াল তাই বন্ধুত্ব তৈরি করতে মানুষ খুব বেশি ভাবনা চিন্তা করছে না। আর সে বন্ধুত্বকে ছুড়ে ফেলতে নূন্যতম চিন্তা করছে না। 

যুগের পরিবর্তন যুবক-যুবতীরাই করছে, তারাই নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারছে। আকাঙ্ক্ষার নৃশংস খুনের পথও শুরু হয় এই ফেসবুক 'প্রেমপর্ব' থেকে। ফেসবুকে যদিও কারো কারো খুবই ঘনিষ্টতা হচ্ছে। তারপরে প্রেম থেকে বিয়ে হচ্ছে। এরপরে নৃশংস খুনও হচ্ছে। বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ায় তরুণ প্রজন্মের সামনে এসব ভয়ঙ্কর বিপদ। না বুঝে এপথে পা বাড়িয়ে অনেকেই জীবনটাকে শেষ করছে। সমাজতত্ত্ববিদরা এগুলোকে নেতিবাচক দৃষ্টিতেই দেখছেন এবং বিভিন্ন অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

পরিশেষে বলতে চাই- ছবি বা ভিডিওতে লাইক দিচ্ছেন, বিনিময়েই আপনার ছবিতে বা ভিডিওতে লাইক দেওয়া অপরপক্ষের একটা সামাজিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। যেকোনো কারণে ইনবক্সে নগ্নতার চাহিদা বাড়তেই থাকে। সেখান থেকেই আরো বেড়ে যাওয়া ভিডিও চ্যাটিংয়ের পাশাপাশি কাছে পাওয়ার বাসনা। চাওয়া-পাওয়ার এমন সূত্র ধরে এক ধরনের 'সম্পর্ক এবং আশা' তৈরি হয়। সে আশা পূরণ না হলে সম্পর্কের অবনতি দেখা দেয়। বলা দরকার, দাম্পত্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ "যৌনতা"। কিন্তু এমন ভাবে কেন? 'আনন্দ এবং সুখকে' আমাদের বুঝতে হবে। প্রকৃত বন্ধুর ভালবাসার টান এবং উশৃঙ্খল যৌনতার টান বা আকাঙ্খা একেবারে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাই এই ফেসবুকের লিলা-খেলার সম্পর্কে চিড় ধরতে বাধ্য। প্রকৃত বন্ধুত্বকে চিনতে হলে সোশ্যাল মিডিয়ার ফেসবুক কেন? বেস্ট ফ্রেন্ডটাকে বেটারহাফ বানানোর আগে সব দিকগুলি ভেবে নেওয়াই উত্তম।

✍️লেখক : নজরুল ইসলাম তোফা, টিভি ও মঞ্চ অভিনেতা, চিত্রশিল্পী, সাংবাদিক, কলামিষ্ট এবং প্রভাষক।