কোথায় বিএনপি!


শফিকুল ইসলাম :
কোথায় বিএনপি!
  • Font increase
  • Font Decrease

বুধবার সকালে নিত্য দিনের বাজার করতে কাওরান বাজারের কাঁচা বাজারের উদ্দেশ্যে আমার গন্তব্য।  রিকশা ভাড়া ঠিক করে উঠে পড়লাম পায়ে চালিত একটি রিকশায়।  রাস্তায় হঠাৎ চোখ পড়লো একটি পোস্টারে।  যেখানে বর্তমান সরকারের নানা উন্নয়ন চিত্র চোখে পড়লো।  রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞাস করলাম কি অবস্থা মামা? কেমন আছেন? সরকার তো বেশ উন্নয়ন করে ফেললো।  রিকশাওয়ালার সোজা সাপটা উত্তর কি যে কন মামা, আমরা যেখানে ছিলাম সেখানেই পড়ে আছি।  উন্নয়ন হচ্ছে বড় লোকদের (ধনীদের)।  বললাম কেন মামা, আপনি তো এখন আর না খেয়ে থাকেন না।  ১০ টাকার ভাড়া দশ বছরে ৩০ টাকা হয়েছে।  কথা শেষ না হতেই রিকশাওয়ালার উত্তর, মামা ১০ বছরে দশ টাকার চাল হয়েছে ৬০ টাকা।  তাইলে আমরা যামু  কই? 

একই কথা যেন বুধবারে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মুখে।  সংবাদ সম্মেলনে তিনি দাবি করলেন, সরকার উন্নয়নের নামে জনগণকে শুভঙ্করের ফাঁকিতে ফেলেছে।  সরকার নিজেরাই নিজেদের মুখে উন্নয়নের কথা বলছে।  জনগণ যেখানে ছিল সেখানেই আছে। তাদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন করতে পারেনি বর্তমান সরকার।  জনগণের পকেট কেটে লোটপাটের রাজত্ব কায়েম করেছে বর্তমান সরকার।  কিন্তু বিষয়টিকে জাতীয় ইস্যু বানাতে বিএনপি কেন ব্যর্থ? আজকের এই লেখায় সেই উত্তর খোজারই চেস্টা মাত্র। 

সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবির পর থেকেই কেন যেন দিন দিন দূর্বল হয়ে পড়েছে প্রতিষ্ঠার পর প্রায় ১৫ বছর রাষ্ট্র পরিচালকের আসনে থাকা এই দলটি।  বর্তমান সরকারের অধীনে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে না গিয়ে বিএনপি একেবারেই যেন হারিয়ে যায় সংসদ থেকে।  গণতান্ত্রিক দল হিসেবে রাস্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিতে চাইলে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জিতে না আসতে পারলে সেটা শুধু মুখে মুখেই গণতান্ত্রিক দল। ঠিক যেমনটি বিএনপি। 

গত এক যুগ ধরে ক্ষমতার বাইরে থেকেও বিএনপি রাস্ট্র পরিচালনায় নিজেদের ভাবনা এবং বক্তব্য গণমাধ্যমের সামনে তুলে ধরেছেন ভিন্ন আঙ্গিকে।  সাধারণ মানুষের কাতার থেকে বের হয়ে পাঁচ তারকা হোটেলে গিয়ে সরকারের বিভিন্ন সমালোচনা এবং নিজেদের ভাবনা তুলে ধরেছে বিএনপি।  বিষয়টি স্বাভাবিকভাবেই জনগণকে আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছে বলেই প্রতীয়মান। 

সর্বশেষ ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ঠিকই আবারো দল এবং দেশের স্বার্থে নির্বাচনে অংশ নেয় দলীয় সরকারের অধীনেই।  কিন্তু ততদিনে আওয়ামীলীগে প্রচার এবং প্রচারণায় অনেক দূর এগিয়ে গেছে। একদিকে বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মীর নামে গায়েবী এবং কেন্দ্রীয় নেতাদের নামে নাম সর্বস্ব মামলা, সঙ্গে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দূর্নীতির মামলায় জেলে।  এই কঠিন সমীকরণেও নির্বাচনের মাঠে বিএনপি খানিকটা দিশেহারা ছিল।  সঙ্গে দলীয় নমিনেশন বেচা কেনার অভিযোগে আবারো তৃণমূল মানুষের মনোযোগ আকর্ষনে ব্যর্থ হয় বিএনপি। 

আগে থেকেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে ফেলা আওয়ামীলীগের জন্য ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন ছিল একটি ভাত-মাছের নির্বাচন।  কিন্তু নির্বাচন পরবর্তী সময়ে নানা কারনে আর রাজপথের আন্দোলনে খুব বেশি সুবিধা করতে পারেনি বিএনপি। তারপর তো করোনা নামক মহামারীতে না চাইলেও ঘরে ঢুকে যেতে বাধ্য হয় বিএনপি। 

করোনার সময়ে দীর্ঘ প্রায় এক বছর ঘরে বসে ভার্চুয়াল মাধ্যমে সরকারের নানা কর্মকান্ডের সমালোচনার পাশাপাশি দরিদ্র অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেস্টা করেছে বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলো।  কিন্তু তাতে আসলে কাজের কাজটা কিছুই হয়নি। এরই মাঝে শর্তসাপেক্ষে কারাগার থেকে মুক্তি মিলেছে বিএনপি চেয়ারপারসনের।  বয়সের ভার, নানারকম অসুস্থ্যতা এবং সরকারের নজরদারী ও মুক্তির শর্ত মেনে চলার কারনে দলীয় কর্মকান্ড থেকে দূরে থাকতে হচ্ছে তাকে। 

এরই মাঝে চলতি মাসে আবারো আলোচনায়  বিএনপি।  ১/১১ সরকারের সময় বিএনপি যে কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা বিএনপিকে বিভক্ত করার চেস্টা করেছিলেন বলে অভিযোগ সেই নেতাদের মধ্যে মেজর (অব) হাফিজ উদ্দিন (বীর বিক্রম) কে নিয়ে।  দলীয় শৃংখার ভঙ্গের অভিযোগে তাকে শো’কজ নোটিশ পাঠায় কেন্দ্রীয় কমান্ড।  তার উত্তরও দিয়েছেন তিনি।  বিষয়টি যে দলের অভ্যন্তরে বড় ধরনের কোন্দলের ইঙ্গিত দিচ্ছে তা বুঝতে বাকি নেই কারো। 

সর্বশেষ আসন্ন স্বাধীনতার সূবর্ণ জয়ন্তী পালনে দেশব্যাপী কমিটি গঠনের মাধ্যমে আবারো সাধারণ মানুষের মনোযোগ আকর্ষণের চেস্টায় মাঠে নেমেছে বিএনপি।  এমনকি ৩০ জানুয়ারি একাদশ সংসদ নির্বাচনের দুই বছর পূরণ উপলক্ষে সারাদেশে বিক্ষোভ সমাবেশের ঘোষণাও দিয়েছে বিএনপি।  প্রশ্ন হলো এই চেস্টা কতটা জনগণের কাছে নিয়ে যেতে পারবে বিএনপিকে? দেখার অপেক্ষায় গণমাধ্যমসহ দেশবাসী। 

৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভরাডুবির পর থেকে নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে বিএনপি এখনো টিকে আছে সাধারণ মানুষের মাঝেই। কিন্তু মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার শক্তির অভাব কোথায়? স্বাধীনতার মূল চেতনা গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে ৯০এর দশকে রাজপথ কাপানো বিএনপির বর্তমান চেহারা জন্য আসলে দায়ী কারা।  এটা কি অভ্যন্তরীণ কোন্দল না কি সরকার কোনোভাবেই চাইছে না যে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল আবারো রাজনীতির মাঠে বিচরণ করুক?

বিষয়টি নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে নানাবিধ মতামত প্রচলিত। বিএনপির একটি বলয় সবসময় চাইছে বিএনপি’র ভেতরেই গণতন্ত্রের প্রচলণ হওয়া দরকার।  তবে দলের চেয়ারপারসন বা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন নিয়ে কোনো পক্ষেরই তেমন কোনো বিরোধ নেই।  তাহলে বিরোধটা কোথায়? বিরোধটা কি তাহলে দলের কেন্দ্রীয়, অঙ্গ এবং সহযোগী সংগঠনগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ সময় এবং ইস্যুতে কাজে লাগাতে না পারা?

অনেকেই মনে করেন বিএনপির মূল সমস্যা হলো, ছাত্রদল এবং যুবদল দলের ক্রান্তিলগ্নে নিশ্চুপ থাকা।  সাবেক ছাত্রনেতাদের হাতে যুবদলের নেতৃত্ব থাকলেও বিভিন্ন কর্মসূচীতে তারা ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নামতে পারছেন না।  সমস্যা কি আসলে মামলা না কি নেতৃত্বে? পত্র পত্রিকায় দেখা যাচ্ছে যে, যুবদলের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতারা আসলে লন্ডনের দিকে চেয়ে থাকেন।  তাহলে দেশের কেন্দ্রীয় নেতারা যা বলেন তা কোনো কাজের না? এমন প্রশ্ন খানিকটা বিব্রতই করবে যুবদলের কেন্দ্রীয় নেতাদের। 

আর ছাত্রদলের সমস্য কোথাও তা কেউ বলতে পারে না।  ইতিহাসে প্রথম স্বচ্ছ ভোটের মাধ্যমে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের পর থেকে আসলে বিভিন্ন জাতীয় দিবসের বাইরে নেই তাদের তেমন কোনো কর্মসূচী।  দেশব্যাপী তৃণমুলের কমিটি গঠনই যেন তাদের একমাত্র কাজ।  তবে কমিটির সময় ফুরিয়ে গেলেও এখনো সেই কাজটিই শেষ করতে পারেনি ছাত্রদল।  বিশেষ করে ছাত্রদের নানা সমস্যা নিয়ে যখন অন্যান্য ছাত্র সংগঠনগুলো সোচ্চার সেখানে খানিকটা নিরব দর্শকের ভূমিকায় ছাত্রদল। 

মূল কথায় আবার ফেরা যাক, রিকশাওয়ালাকে যখন জিজ্ঞাস করেছিলাম কত বছর তিনি তেজগাঁওতে রিকশা চালান।  বললেন, প্রায় ৩০ বছর।  জিজ্ঞাস করেছিলাম কেমন ছিল আগের দিনগুলো।  সহজ ভাষায় উত্তর, মামা আগে সারাদিনে ২শ টাকা কামিয়ে সন্তানদের জন্য কিছু জমাতে পারতাম।  এখন আর সেই দিন নাই। 

জিজ্ঞাস করেছিলাম, একটা সময় তো পুরো তেজগাঁওতে বিএনপি রাজত্ব করতো।  এখন কেমন দেখেন মামা? তিনি আবারো সহজ ভাষায় বললেন, কোথায় বিএনপি! দেখি না তো!