৬ জানুয়ারি কি ঘটতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে!
এক সময় বলা হতো ব্রিটিশ সম্রাজ্যে কখনো সূর্যাস্ত হয় না। ছেলেবেলায় শোনা সেই কথাকে রুপকথার গল্প মনে হলেও ইতিহাস থেকে জেনেছি, সারা পৃথিবী জুড়ে ব্রিটিশরা এত এত দেশ শাসন করতো যে পশ্চিম আকাশে সূর্য অস্ত গেলে পৃথিবীর আহ্নিক গতির কারনে ব্রিটিশ শাসিত পূর্বাঞ্চলের কোনো না কোনো দেশে তখন সূর্য উদয় হতো।
বর্তমান পৃথিবীর বাস্তবতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও তেমনি এক রাষ্ট্র যার ছায়া বা সহযোগিতা ছাড়া তৃতীয় বিশ্বের মত বাংলাদেশ তো বটেই ইউরোপ বা ল্যাটিন আমেরিকার মত পুজিবাদী দেশও চলতে পারে না। সহজ কথায় বলতে গেলে, চলতে দেওয়া হয় না।
স্বাভাবিকভাবেই তাই আমাদের আগ্রহ থাকে বাংলাদেশকে নিয়ে বা দক্ষিণ এশিয়া বা এশিয়া মহাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কখন কি বলেন সেই দিকে। আর যদি প্রেসিডেন্ট যদি একই বিষয়ে কথা বলেন তাহলে তা তো অনেক ওপরেরই কথা।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এমন এক জায়গায় নিয়ে গেছে যে, সেখানে স্বাধীন মত প্রকাশে কারো কোনো বাধা নেই। ফেডারেল ব্যবস্থায় পরিচালিত পৃথিবীর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার আধুনিক দৃষ্টান্ত টানতে গেলেই চলে আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন প্রসঙ্গ।
সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্র হওয়ার সুবাদে নির্বাচন বিষয়ক রিপোর্টিং বিষয়ে যত পড়াশোনা করেছি সেখানে একটা দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাই বার বার উঠে এসেছে বিভিন্ন গবেষণাই। তা হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন।
সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্র হিসেবে ‘ম্যাজিক বুলেট থিওরি’র নাম শোনেনি এমন ছাত্র নেই। সেই ম্যাজিক বুলেট থিওরির মূল বিষয়ও মার্কিন নির্বাচন। তথ্য কিভাবে জনগণকে সরাসরি আঘাত হানে সহজ ভাষায় বলতে গেলে জনগণকে কিভাবে প্রভাবিত করে তারই উদাহরণ হলো ম্যাজিক বুলেট থিওরি। এমন অসংখ্য গবেষণা বা থিওরি গড়ে উঠেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন ঘিরে।
তবে ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন নিয়ে যে ধরনের কাঁদা ছোড়াছুড়ি হচ্ছে তা আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদলের ইতিহাসকেও হার মানাচ্ছে। এটা নিয়ে আদর্শিক কোনো গবেষণা হবে কি না তা ভবিষ্যৎই ঠিক করবে। তবে আপাতত যুক্তরাষ্ট্রের গেলো ৪৫টি প্রেসিডেন্সিয়াল ইলেকশনে এমনটা কখনো হয়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণার সময় থেকেই ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট ডোনল্ড ট্রাম্প ও তার দল রিপাবলিকান পার্টির কেন্দ্রীয় নেতারা ভোট কারচুপির আশঙ্কা করে আসছিলেন। এরই মধ্যে ট্রাম্পের করোনা আক্রান্তের খবর রিপাবলিকান শিবিরের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেললেও মাত্র ১০ দিনের মাথায় পৃথিবীর সেরা চিকিৎসা নিয়ে আবারো নির্বাচনের মাঠে নেমে পড়েন ট্রাম্প। জনমত জরিপে সামান্য ব্যবধানে এগিয়ে থেকে বাইডেন শিবির নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে গেলেও তারাও জানতে ক্ষাপাটে ট্রাম্প যে কোনো সময় বড় ধরনের গোলযোগ বাধাতে পারেন।
নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর ঠিক তাই হলো। বিভিন্ন স্টেটে নির্বাচনী ফল স্থগিত করা থেকে শুরু করে ফলাফল পাল্টে দেওয়ার জন্য নির্বাচনী কর্মকর্তাদের ওপর চাপ দিতে থাকলেন ট্রাম্প। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেশটির সুপ্রিম কোর্টের মামলায় হেরে যাওয়া বিকল্প পথে হাটতে থাকলেন ট্রাম্প। প্রতিনিধি পরিষদে নিজ দলের কয়েকজন সদস্যকে নিয়ে এবার নোংরা খেলায় মেতে উঠলেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের নিয়ম অনুযায়ী ইলেক্টোরাল কলেজের সদস্যরা তাদের পছন্দের প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে ভোট দেবেন প্রথমে। সেই ভোট আবার প্রত্যায়ন হবে প্রতিনিধি পরিষদে। সেখানে কোনো সদস্য ফলফলের ওপর ভেটো দিলে তা নিয়ে আবার বিতর্ক অনুষ্ঠিত হওয়ার বিধান রয়েছে। প্রতিটি বির্তকে সময় লাগে ৩ থেকে ২১ দিন। আর ইলেক্টোরাল কলেজের ভোট প্রতিনিধি পরিষদ বা যুক্তরাষ্ট্রের নিম্ন কক্ষে প্রত্যায়ন দিন ৬ জানুয়ারি।
সব রাস্তায় ফেল করা ট্রাম্প এখন হাটছেন প্রতিনিধি পরিষদে নিজ দলের সদস্যদের ঘাড়ে চেপে ৬ জানুয়ারির ফল পাল্টাতে। আর তা যদি হয় তাহলে স্বাভাবিকভাবেই ইলেক্ট প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের শপথও পিছিয়ে যেতে পারে। কারন প্রতিনিধি পরিষদে দেড় শতাধিক সদস্য রয়েছে রিপাবলিকান পার্টির। এর মধ্যে ১০ শতাংশ সদস্যও যদি ইলেক্টোরাল কলেজের ভোটকে প্রত্যায়নে ভেটো দেয় তাহলে আরো কিছু সময় ক্ষমতায় থেকে যেতে পারেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
এরই মধ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্প তার নিজ এবং দলের অনুসারীদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, কেন আমেরিকার জনগণ অস্ত্র হাতে তুলে নিচ্ছে না? এমনকি ইলেক্টোরাল কলেজের আনুষ্ঠানিক ভোটের দিনও রিপাবলিকান পার্টির বিশাল সমাবেশে শেষ মুহুর্তে আমেরিকাতে বিশৃঙ্খলা হতে পারে বলে হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
আমেরিকার জনগনের করোনাকালীন মৌলিক অধিকার স্টিমুলাস প্যাকেজে সই না করে ফ্লোরিডার ‘ মারে লা গো’ রিসোর্টে ছুটি কাটাতে গিয়ে সদ্য প্রেসিডেন্টের ক্ষমাপ্রাপ্ত দাগী অপরাধী আর কুটিল আইনজীবীদের নিয়ে গলফ খেলার ফাঁকে কিভাবে ৬ জানুয়ারি প্রতিনিধি পরিষদে ইলেক্টোরাল কলেজের আনুষ্ঠানিক ফলাফল প্রত্যায়নে বাধা দেওয়া যায় তার ছক কষেন ট্রাম্প। তাইতো প্রমোদ ভ্রমণ সংক্ষিপ্ত করে আবারো হোয়াইট হাউজে ফেরেন তিনি।
এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এই প্রথম প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকারের বাসায় হামলার ঘটনা ঘটেছে। প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির বাসার দেওয়ালে রোববার রাতে লাল রঙ দিয়ে নানা স্লোগান লেখা হয়েছে। বাড়ির সামনে শুকরের কাটা মাথা ফেলা রাখা নতুন সহিংসতার ইঙ্গত দিচ্ছে বলেই খবর প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো।
উল্টো দিকে আমেরিকার বেকারদের জন্য ডেমোক্রেট দলের প্রস্তাবিত ২ হাজার ডলার স্টিমুলাস প্যাকেজ প্রস্তাবে বাধা দেওয়া রিপাবলিকান নেতা মিচ ম্যাককনেলের বাসাতেও হামলার ঘটনা বেশ উদ্বেগে ফেলেছে আমেরিকান সাধারণ জনগণকে।
যদি ৬ জানুয়ারি ডেমোক্রেট নিয়ন্ত্রিত প্রতিনিধি পরিষদে ইলেক্টোরাল কলেজের ভোট প্রত্যায়ন সর্বসম্মতভাবে পাশ না হয় তাহলে কোন দিকে যাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা হস্তান্তর পালা। বাইডেন কি ২০ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট হয়ে হোয়াইট হাউজে যাবেন। না কি ডোনাল্ড ট্রাম্পই আবারো চার বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট হিসেবে হোয়াইট হাউজে থেকে যাবেন?
৬ জানুয়ারিকে ঘিরে ইতিমধ্যে বাড়তি তৎপরতা শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা এবং পুলিশ। দেখার অপেক্ষার কি ঘটে আধুনিক গণতন্ত্রের সুতিকাগার যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা ওয়াসিংটন ডিসি এবং হোয়াইট হাউসের ভাগ্যে।