শাপলা চত্বর তান্ডবের ৮ বছর : পৃষ্ঠপোষক ছিল বিএনপি-জামায়াত!
২০১৩ সালের ৫ মে রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশের অর্থ যোগান দিয়েছিল বিএনপি-জামায়াত। সম্প্রতি আদালতে দেয়া ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এমন কথা বলেছেন হেফাজত ইসলামের ঢাকা মহানগর কমিটির তৎকালীন প্রচার সম্পাদক মুফতি ফখরুল ইসলাম।
গত ১৯ এপ্রিল মুখ্য মহানগর হাকিম দেবদাস চন্দ্র অধিকারীর আদালতে তিনি এই স্বীকারোক্তি দেন। স্বীকারোক্তিতে তিনি জানান, জামায়াতের নেতা-কর্মীরা সরাসরি হেফাজতের কর্মসূচীতে ঢুকে জ্বালাও পোড়াও করে সরকারের পতন ঘটাতে চেয়েছিল। শাপলা চত্বরের সমাবেশের ঠিক এক সপ্তাহ আগে খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেন জুনায়েদ বাবুনগরী। বিএনপির পক্ষ থেকে ওই আন্দোলনে জন্য অর্থ সহায়তা দেয়া হয়।
গত ১৪ এপ্রিল লালবাগ এলাকা থেকে মুফতি ফখরুলকে গ্রেফতারের পর পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেয় গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। রিমান্ড শেষে তিনি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এরপর আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
গোয়েন্দা পুলিশ সূত্র জানায়, ২০১৩ সাল থেকেই জুনায়েদ বাবুনগরী বিএনপি-জামায়াত ঘেঁষা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। আহমদ শফীর জন্য আগে তেমন সুবিধা করতে পারেননি। তার মৃত্যুর পর বাবুনগরীর আমীর নির্বাচিত হলে হেফাজত পুরোপুরি ‘অ্যান্টি গভর্নমেন্ট অ্যাক্টিভিটিজ’ শুরু করে দেয়। এরই ফলশ্রুতিতে গত বছরের শেষের দিকে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপন নিয়ে বিরোধিতা শুরু করে চলতি বছরে মোদি বিরোধী আন্দোলনের নামে সহিংসতা শুরু করে।
এদিকে গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে সাবেক হেফাজত নেতা মামুনুল হক বলেছেন, ২০১৩ সালে বিএনপির পেছনে থেকে ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমের স্বপ্ন দেখতেন তারা। হেফাজত নেতারা মনে করতেন, হেফাজতই সামনে থেকে নেতৃত্ব দেবে আর বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলে তাদের পেছনে থাকবে। এমনকি রিমান্ডে নেয়ার পরও মামুনুল হক মনে করতেন, তার দলের নেতাকর্মীরা ডিবি অফিসে হামলা চালিয়ে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবে।
তবে দলের আমীর বাবুনগরীর বক্তব্য তাকে দেখানোর পর তিনি হতাশ হয়েছেন। এমনকি দলের মহাসচিব মাওলানা নুরুল ইসলাম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় যাওয়াতেও হতাশ মামুনুল। প্রথম দিকে হম্বিতম্বি করলেও এখন অনেকটাই থেমে গেছেন। গত ২৬ মার্চ আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পতনের চেষ্টার কথাও তিনি জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন।
ফিরে দেখা ৫ মে, ২০১৩ : আট বছর আগের এই দিনে কওমি মাদরাসাভিত্তিক সদ্য প্রসূত সংগঠন হেফাজতে ইসলাম, ইসলাম ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করার অভিযোগে ঢাকা অভিমুখে লংমার্চের নামে ঢাকা অবরোধ করে। মতিঝিলের শাপলা চত্ত্বর এবং এর আশপাশে অবস্থান নেয়। এ সময়ে তারা কয়েকজন ব্লগারের বিরুদ্ধে ইসলাম ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে ১৩দফা দাবিতে এ গণসমাবেশের আয়োজন করে।
এ দিন সকাল থেকেই তারা দল বেঁধে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে জমায়েত হয়। শাপলা চত্বরের উপরে স্টেজ করে চলতে থাকে তাদের তৎপড়তা। সরকারের পক্ষ থেকে তাদের বারবার চলে যাওয়ার অনুরোধ করা হলেও তারা তা কর্ণপাত না করে সরকার বিরোধী নানা বক্তব্য ও কার্যক্রম চালাতে থাকে।
ফজরের নামাযের পরই ঢাকার প্রবেশপথগুলো দখলে নিয়েছিলেন হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা। ঢাকার গাবতলী বাস টার্মিনাল, টঙ্গী, সায়েদাবাদ, কাঁচপুর ব্রিজসহ রাজধানীকে ঘিরে ছয়টি প্রবেশমুখেই অবরোধ তৈরি করেছিলেন হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে সারাদেশ থেকে আসা কওমি মাদ্রাসার হাজার হাজার ছাত্র-শিক্ষকরা। বেলা যত বাড়তে থাকে অবরোধকারীদের মাঝে উত্তেজনা ছড়াতে থাকে।
এক পর্যায়ে ঢাকার ভিতরে প্রবেশ করে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে গণসমাবেশ করার ঘোষণা দেয়া হয়। এর পরেই হেফাজতে ইসলামের নেতারা শাপলা চত্বরে যাওয়ার ঘোষণা দেয়ার পর অনুমতির জন্য পুলিশের সাথে আলোচনা শুরু করেন। কিন্তু বেলা সাড়ে ১১টায়, অনুমতি আসার আগেই নেতা কর্মীরা মিছিল করে ঢাকার অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে এবং প্রবেশ মুখগুলোতে সংঘর্ষ শুরু হয় ।
সময় বাড়তে থাকার সঙ্গে সঙ্গেই বাড়তে থাকে সংঘর্ষ। যা শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, পল্টন, বায়তুল মোকাররম এলাকায় ছড়িয়ে পরে। এক পর্যায়ে হেফাজতের নেতারা বায়তুল মোকাররম মসজিদে আক্রমণ করে। পুড়িয়ে দেয় কোরআন শরীফসহ মসজিদের আসবাবপত্র।
দুপুর দেড়টার সময়ে তারা শাপলা চত্বরে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করে। এ সময় আশপাশের এলাকার বিভিন্ন ভবনে অগ্নিসংযোগ, সংঘর্ষ ও সহিংসতা চলতে থাকে। পুলিশও দফায় দফায় টিয়ারশেল, ফাঁকাগুলি, সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে ভয় দেখাতে থাকে। গোটা এলাকাই এ সময় যুদ্ধক্ষেত্রে রূপ নেয় ।
সন্ধ্যায় শাপলা চত্বরে অবস্থান নেয়া হেফাজত নেতাদের সেখানে অবস্থান করার ঘোষণায় বিএনপির অবস্থান নিয়েও শুরু হয়েছিল নানা রাজনৈতিক বিতর্কও। রাত সাড়ে দশটা, পুলিশ নিরাপত্তা দিয়ে হেফাজতে ইসলামের তৎকালীন প্রধান শাহ আহমদ শফিকে লালবাগ মাদরাসা থেকে নিয়ে শাপলা চত্বরের দিকে রওনা হলেও পরে তিনি অসুস্থবোধ করলে শেষ পর্যন্ত তিনি আর শাপলা চত্বরে যেতে পারেননি। রাতে অবশ্য জমায়েতও অনেকটা কমে গিয়েছিল।
রাত সোয়া একটা, শাপলা চত্বরে অবস্থান নেয়াদের বিতাড়িত করার জন্য আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা সম্মিলিতভাবে অভিযানের প্রস্তুতি নেয়। তারা দৈনিক বাংলার মোড়, দিলকুশা, ফকিরাপুল এবং নটরডেম কলেজের সামনে অবস্থান নেয়। অবস্থানকারীদের সরে পড়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে কমলাপুর ষ্টেশন যাওয়ার রাস্তা এবং বঙ্গভবনের দিকের রাস্তা খোলা রাখা হয়েছিল।
অন্য তিন দিক থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা প্রথমে হাত মাইক ব্যবহার করে অবস্থানকারীদের সরে যেতে বলে। কিন্তু এ সময়ে শাপলা চত্বরের উপরে নির্মীত মঞ্চ থেকেও নেতাকর্মীদের উত্তেজিত করতে দেয়া হয় নানা বক্তব্য।
রাত পৌনে তিনটা। শুরু হয় মুল অভিযান। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তিন দিক থেকে ফাঁকা গুলি, কাঁদানে গ্যাস এবং সাউন্ড গ্রেনেডও ছুড়তে থাকেন। এর আগে পুরো এলাকার বিদ্যুৎ লাইন বিচ্ছিন্ন করে পুরো এলাকা অন্ধকার করে দেয়া হয়।
মুহূর্তেই খালি হয়ে যায় মঞ্চ। সমাবেশস্থল বেশ কয়েকজনকে আটক করে পুলিশ। অভিযানের সময় হেফাজতের শত শত কর্মী সমর্থক মতিঝিল এলাকায় বিভিন্ন ভবনে আশ্রয় নিয়েছিলেন। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা পুরা এলাকার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে বিভিন্ন ভবনে আশ্রয় নেয়াদের বের করে এনে ঐ এলাকা ছেড়ে যেতে সহায়তা করেন।
তবে শাপলা চত্বরে সেই রাতের অভিযান, আহত ও নিহতের সংখ্যা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক বিতর্ক দেখা দিলেও তা শেষ পর্যন্ত তা অমীমাংসিতই থেকে গেছে।