ঢাকামুখী মানুষের ঢল
করোনা সংক্রমণ দিন দিন বেড়েই চলছে। বাড়ছে করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু সংখ্যাও। কঠোর বিধিনিষেধ দিয়েও সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। কারণ চলমান ‘কঠোর লকডাউন’ মানছে না সাধারণ মানুষ।
শহর অঞ্চলে মানুষের চলাচলের ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি থাকলেও গ্রাম অঞ্চলে তেমনটা নেই। গ্রামে স্বাস্থ্যবিধি তো দূরের কথা মুখে মাস্কও পরছে না অনেকেই।
কঠোর লকডাউনের মধ্যে গ্রাম ছেড়ে ঢাকামুখী হচ্ছে অনেক মানুষ। এদের বেশিরভাগেই নিম্ন আয়ের মানুষ। ঈদের আগে বিভিন্ন যানবাহনে গাদাগাদি গ্রামে গিয়েছিল তারা। ঈদের পর পর লকডাউন শুরু হওয়ায় আটকা পড়েছেন অনেকেই। ৫ আগস্টের পর লকডাউন আরও বাড়ানো হতে পারে এই খবরে তারা এখন ঢাকামুখী।
গতকাল মাদারীপুরের বাংলাবাজার ফেরিঘাটের স্থানীয় প্রতিনিধির সঙ্গে কথা হয় ফরিদপুর থেকে ঢাকামুখী যাত্রী লিয়াকত হোসেনের সঙ্গে। লিয়াকত ফুটপাতে ফল বিক্রি করে। ঈদের আগের গ্রামের বাড়ি যান তিনি। কিন্তু লকডাউনের কারণে আটকা পড়েছেন। ঢাকায় ফল বিক্রি না করলে তার সংসার চলবে না। লকডাউন আরও বাড়তে পারে। তাই গণপরিবহন বন্ধের মধ্যেও ভেঙে ভেঙে ঢাকা যাচ্ছেন তিনি।
লিয়াকত বলেন, ‘ঢাকায় গিয়ে ফল বিক্রি না করলে নিজে ও পরিবারের সদস্যরা বাঁচবো কিভাবে।’ করোনায় মরার ভয় থেকে অর্থাভাবে জীবন-সংসার নিয়ে বাঁচার ভয় বেশি তাদের।
অসুস্থ এক আত্মীয়কে দেখতে ঝুঁকি নিয়ে নড়াইল থেকে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করেছেন মনির হোসেন নামের এক যাত্রী। তিনি বলেন, ‘আমার এক আত্মীয় খুব অসুস্থ তাই তাকে দেখতে ঢাকা যাচ্ছি। সারাপথ ইজিবাইকে ভেঙে ভেঙে তিনগুণ ভাড়া দিয়ে ঘাটে এসেছি। এখন ফেরিতে উঠেছি। ফেরিতে এত বেশি যাত্রী যে এক জনের শরীরের সঙ্গে আরেকজন মিশে দাঁড়ানো লাগছে। আর মাস্কতো নেই অনেকের মুখেই।’ এভাবেই ‘কঠোর লকডাউনের’ মধ্যে মানুষ ঢাকায় আসছেন আবার ঢাকা থেকে বের হয়ে যাচ্ছেন। কয়েকগুণ বেশি ভাড়া ও পথে পথে ভোগান্তির পরও মানুষের চলাচল বন্ধ হচ্ছে না।
ঢাকায় ফিরছেন মানুষ। গতকাল সকাল থেকেই ফেরিঘাটসহ রাজধানীর বিভিন্ন প্রবেশপথে ছিল ঢাকামুখী মানুষের ভিড়। মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া-বাংলাবাজার ও মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ও আরিচা ফেরিঘাট দিয়ে ঢাকায় ফিরতে দেখা গেছে অনেককেই। এছাড়া কাঁচপুর সেতু, সাভারের আমিনবাজার সেতু, উত্তরার আবদুল্লাহপুর ও গাজীপুরের টঙ্গী ব্রিজ পার হয়ে অনেক যাত্রীদের ঢাকা প্রবেশ করতে দেখা গেছে। হাতে ও কাঁধে ব্যাগ নিয়ে হেঁটেই সেতু পার হয়ে ঢাকায় প্রবেশ করতে দেখা গেছে তাদের।
রাজধানীর আমিনবাজার এলাকায় রায়হান নামের পাবনার এক যাত্রী বলেন, ‘আমি গাজীপুরের এক গার্মেন্টেসে চাকরি করি। ঈদের আগে বাড়িতে গিয়েছিলাম। দুই-একদিনের মধ্যে গার্মেন্টস খুলবে অফিস থেকে বলেছে। তাই ঢাকায় যাচ্ছি। সিএনজি অটোরিকশা ও মাইক্রোবাসে ভেঙে ভেঙে ঢাকায় আসতে হয়েছে।’
উত্তরার আবদুল্লাপুর এলাকায় সাইদুর রহমান নামের শেরপুরের এক যাত্রী বলেন, ‘কোরবানির ঈদ বাড়িতে করি প্রতিবার। গতবছর যাই নাই। তাই এবার গিয়েছিলাম। যাওয়ার সময় শুনছিলাম লকডাউন ঈদের পর বেশি কড়া থাকবে না। কিন্তু ঈদের তিনদিনের দিন থেকেই কড়া লকডাউন শুরু হয়। তাই পরিবার নিয়া আসি নাই। বাড়িতে বইসা থাকতে আর ভালো লাগে না। এদিকে দোকান না খুললে পড়ে খামু কি। তাই এক সপ্তাহ থাইকা আজ ঢাকায় আইসা পড়লাম। বাড়িওয়ালা দুই দিন ফোন করছিল। গত মাসের ভাড়া বাকি আছে। তাই চইলা আসলাম।’ প্রতিনিধি শিবচর (মাদারীপুর) : কঠোর লকডাউনে বাংলাবাজার-শিমুলিয়া নৌরুটে যাত্রীদের চাপ ছিল বেশি। গতকাল সকাল থেকেই ঢাকামুখী যাত্রীর পাশাপাশি দক্ষিণাঞ্চলমুখী যাত্রী ছিল অনেক। ফেরি চলাচল আগের তুলনায় সীমিত করায় গাদাগাদি করে যাত্রীরা পদ্মা নদী পার হতে দেখা গেছে। বর্তমানে ৬টি ফেরি চলাচল করছে বলে অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) সূত্র জানায়।
লঞ্চসহ অন্যান্য নৌযান বন্ধ রয়েছে। ফেরিতে স্বাস্থ্যবিধি মানার তেমন কোন লক্ষণ নেই। পদ্মায় পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় শ্রোতের গতিও বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে ফেরি পারাপারে দীর্ঘ সময় লাগছে। যাত্রীরা কয়েকগুণ বেশি ভাড়ায় অটোরিকশাসহ ছোট ছোট যানবাহনে ভেঙে ভেঙে ফেরিঘাটের পৌঁছতে দেখা গেছে।
প্রতিনিধি, শিবালয় (মানিকগঞ্জ) জানায়, কঠোর বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে জীবন ও জীবিকার তাগিদে মানুষ ঘর ছেড়ে ছুটছে শহরের দিকে। গতকাল সকাল থেকে পাটুরিয়া আরিচা ঘাট সরেজমিন পরিদর্শন করে দেখা গেছে, কুষ্টিয়া-খুলনা, রাজবাড়ী, গোয়ালন্দ, দৌলোদিয়া, মাদারীপুর, মাগুরা এবং অন্যদিকে কাজিরহাট, কাশিনাথপুর, পাবনা, বেরাসহ বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা হতে শত শত মানুষ আরিচা ও পাটুরিয়া ঘাটে এসে রিকশা-ভ্যান, অটোরিকশা, মোটরসাইকেলযোগে ঢাকায় যেতে দেখা গেছে। রিকশা ও অটোরিকশা ওয়ালারা এই সুযোগে যাত্রী প্রতি ৫০০, ১০০০ ও ১৫০০ টাকা দাবি করছেন। নিরুপায় সাধারণ মানুষ বাধ্য হয়ে দাবি অনুযায়ী টাকা পরিশোধ করে অতিকষ্টে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হচ্ছেন।
যাত্রীরা বলেন, বাড়ি থাকার কোন উপায় না পেয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন। যেনতেনভাবে কোন কাজ করে বাড়ির খরচ পাঠাতে হবে। নইলে অনাহারে থাকতে হবে অনেককেই।
বিআইডব্লিউটিসির আরিচা কার্যালয়ের ডিজিএম জিল্লুর রহমান বলেন, ‘লকডাউনের জন্য জরুরি সেবায় নিয়োজিত গাড়ি ছাড়া সব ধরনের যানবাহন পারাপার বন্ধ রয়েছে। সেজন্য বর্তমানে ১৬টি ফেরির মধ্যে ৮টি ফেরি দিয়ে জরুরি যানবাহনগুলো পার করছি তবে এই গাড়িগুলো পার করার সময় কিছু যাত্রী নৌপথ পার হচ্ছে।’
প্রতিনিধি, শিবচর (মাদারীপুর) জানায়, কঠোর লকডাউনের ৮ম দিনে বাংলাবাজার-শিমুলীয়া নৌরুটে যাত্রীদের চাপ রয়েছে। গতকাল সকাল থেকেই ঢাকামুখী যাত্রীর পাশাপাশি দক্ষিণাঞ্চলমুখী যাত্রীদের চাপ রয়েছে। ফেরি চলাচল আগের তুলনায় সীমিত করায় গাদাগাদি করে যাত্রীরা পদ্মা পাড়ি দিচ্ছেন। এ রুটে ৬টি ফেরি চলছে । লঞ্চসহ অন্যান্য নৌযান বন্ধ রয়েছে। ফেরিতে স্বাস্থ্যবিধি মানার তেমন কোন লক্ষণ নেই। এদিকে পদ্মায় পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় ¯্রােতের গতিও বৃদ্ধি পেয়ে ফেরি পারাপারে দীর্ঘ সময় লাগছে। যাত্রীরা কয়েকগুণ ভাড়া গুনে দুই-তিন চাকার যানবাহনে দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলো থেকে ঘাটে ও ঘাট থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে পৌছাচ্ছেন। নানা অজুহাতে যাত্রীরা ছুটছেন। এদিকে গত বৃহস্পতিবার বৈরী আবহাওয়ার কারণে দীর্ঘ সময় ফেরি বন্ধ থাকায় কয়েকশ’ পণ্যবাহী ট্রাক পারাপারের অপেক্ষায় উভয় ঘাটে আটকা রয়েছে।
নড়াইলের মনির হোসেন বলেন, আমার এক আত্মীয় খুব অসুস্থ তাই তাকে দেখতে ঢাকা যাচ্ছি। সারাপথ ইজিবাইকে ভেঙে ভেঙে তিনগুণ ভাড়া দিয়ে ঘাটে এসেছি। এখন ফেরিতে উঠেছি। ফেরিতে এত বেশি যাত্রী যে এক জনের শরীরের সঙ্গে আরেকজন মিশে দাঁড়ানো লাগছে। আর মাস্কতো নেই অনেকের মুখেই।
ফরিদপুর থেকে আসা লিয়াকত হোসেন বলেন, ঢাকায় ফুটপাতে ফল বিক্রি করি। ঈদের সময় বাড়ি গিয়েছিলাম এখন আবার ঢাকা যাচ্ছি। ঢাকায় গিয়ে ফল বিক্রি না করলে নিজে ও পরিবারের সদস্যরা বাঁচবো কিভাবে।
বিআইডব্লিউটিসি বাংলাবাজার ঘাট ম্যানেজার মো. সালাউদ্দিন বলেন, নৌরুটে সীমিত আকারে যে কয়েকটি ফেরি চলাচল করছে তাতে পণ্যবাহী ট্রাক, অ্যাম্বুলেন্সসহ জরুরি গাড়ি পারাপার করা হচ্ছে। যাত্রীদের ভিড় থাকায় ফেরিতে যাত্রীদেরও বহন করা হচ্ছে। আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে ফেরিতে উঠতে যাত্রীদের অনুরোধ করছি।
প্রতিনিধি, গোয়ালন্দ (রাজবাড়ী) জানায়, করোনা সংক্রমণ রোধে সরকার ঘোষিত কঠোর লকডাউন, গণপরিবহন বন্ধ থাকায় পথে পথে ভোগান্তি, বৈরী আবহাওয়া ও উত্তাল পদ্মাও থামাতে পারছে না কর্মমুখী মানুষকে। জীবন ও জীবিকার তাগিদে শত শত মানুষ ছুটছে ঢাকার পথে।
সরেজমিন দৌলতদিয়া ফেরিঘাট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, গত কয়েকদিনের মতো গতকালও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকার নিম্নআয়ের শ্রমজীবী সাধারণ মানুষ কঠোর বিধিনিষেধ, বৈরী আবহাওয়া উপেক্ষা করে ছোট ছোট যানবাহনে অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে এসে ফেরিতে উত্তাল পদ্মা পাড়ি দিচ্ছেন। এ সময় স্বাস্থ্যবিধি তো দূরে থাক অনেকের মুখেই ছিল না মাস্ক।
যশোর থেকে আসা গাজীপুরগামী গার্মেন্ট কর্মী রহিমা বেগম বলেন, ‘প্যাটে ভাত না থাকলে মরার ভয় থাকে না, কিশের করোনা, কিশের ঝড় বৃষ্টি ঢাকায় গিয়ে কাজে যোগ দিতে অইব, তা না হলে চাকরি থাকবো না।’ মাগুরা থেকে আসা ঢাকাগামী প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরিরত শরীফ আহমেদ বলেন, ছুটি শেষ হয়েছে আগেই, কঠোর লকডাউনের কথা শুনে ভেবেছিলাম কয়েকদিন পরেই যায়। কিন্তু অফিসের অন্য স্টাফরা সবাই কাজে যোগ দিয়েছে, বস অনেক বকাঝকা করেছেন তাই এক প্রকার বাধ্য হয়েই চাকরি বাঁচাতে ঢাকায় যাচ্ছি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) দৌলতদিয়া ঘাট শাখার ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) মো. জামাল হোসেন বলেন, বৈরী আবহাওয়ার সঙ্গে ঝড়োবৃষ্টি হওয়ায় ফেরিতে যানবাহন কম। তাই সকাল থেকে সাধারণ যাত্রীরাই পার হচ্ছে। বর্তমানে এ নৌরুটে ছোট বড় মিলিয়ে ৯টি ফেরি চলাচল করছে।