পরিবহন ধর্মঘট : সারাদেশে সর্বত্র দুভোর্গ
সরকার জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোয় দেশব্যাপী চলছে পরিবহন ধর্মঘট। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ জনগণ। গণপরিবহনের পাশাপাশি বন্ধ রয়েছে পণ্যবাহী গাড়িগুলোও। বাস বন্ধ থাকায় কয়েক গুণ বেশি ভাড়ায় যাত্রী পরিবহন করছে রিকশা ও অটোরিকশাগুলো। কয়েকটি জেলায় রাস্তায় স্থানীয় যানবাহন আটকে যাত্রীদের নামিয়ে দিয়েছেন পরিবহন শ্রমিকরা।
শুক্রবার সকাল থেকে রাজধানীর প্রবেশ মুখ সাভারে সীমিত পরিসরে বাস ও লেগুনাসহ স্থানীয় গণপরিবহন চলতে দেখা গেছে। তবে গণপরিবহনে যাতায়াতের সময় যাত্রীদের কয়েকগুণ বেশি ভাড়া গুনতে হচ্ছে। ভাড়া নিয়ে বাসের হেল্পার ও চালকদের সঙ্গে বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েছেন যাত্রীরা।
সকালে সাভার বাস স্ট্যান্ড এলাকায় গাবতলি যাওয়ার উদ্দেশে প্রায় ঘণ্টাখানেক দাঁড়িয়ে থাকার পর বাসে উঠতে পারেন আশিকুর রহমান। তিনি বলেন,'গাবতলী পর্যন্ত বাসের ভাড়া জনপ্রতি ১০০ টাকা টাকা চাওয়া হচ্ছে। বাস কম থাকায় নিরুপায় হয়েই ৩৫ টাকার ভাড়া ১০০ টাকা দিয়ে যেতে হয়েছে।'
গাজীপুরের ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের রাজেন্দ্রপুর চৌরাস্তা, হোতাপাড়া, ভবানীপুর, মাওনা চৌরাস্তা, জৈনাবাজার এলাকা ঘুরে কোথাও আন্ত:জেলা যাত্রীবাহী পরিবহন চলাচল করতে দেখা যায়নি। তবে পণ্যবাহী কাভার্ডভ্যান ও স্থানীয় যানবাহন চলাচল করেছে। বেশ কয়েকটি রাস্তায় পরিবহন শ্রমিকদের স্থানীয় যানবাহন আটকে যাত্রীদের নামিয়ে দিতে দেখা গেছে।
গাজীপুর সদর উপজেলার বাঘের বাজার থেকে ময়মনসিংহ যাওয়ার জন্য মাওনা চৌরাস্তা উড়ালসেতুর নিচে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিলেন ইউসুফ আলী (৭৫)। জানান, ময়মনসিংহ যাওয়ার জন্য বেলা সাড়ে ১১টা থেকে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত উড়ালসেতুর আশপাশে ঘুরে কোথাও তিনি গাড়ি পাননি। স্থানীয় যানবাহনগুলো দূরবর্তী এলাকায় যাচ্ছে না। সিএনজিচালিত অটোরিকশাগুলো চার থেকে পাঁচ গুণ বেশি ভাড়ায় যাত্রী পরিবহন করছে।
ময়মনসিংহের গফরগাঁও সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী আরিফুল ইসলাম হৃদয় বলেন, 'টঙ্গীর উদ্দেশে বাড়ি থেকে বের হয়ে কোনোমতে মাওনা চৌরাস্তা আসার পর শ্রমিক নেতারা উড়ালসেতুর উত্তরপাশে বাস আটকায়। এসময় তারা যাত্রীদের নামিয়ে দিয়ে গাড়িটি উল্টোদিকে ঘুরিয়ে দেয়।'
চালকরা বলছেন, তেলের দাম বাড়লেও পরিবহন ভাড়া বাড়েনি। এ অবস্থায় মহামারি পরবর্তী সময়ে সংসারের খরচ চালানো কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে।
ট্রাকচালক মো. জিয়ার হোসেন বলেন, 'গাড়ি চালালে ১০ টাকার ভাড়া গুণলে ১২টাকা খরচ হয়। সে কারণে শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তে গাড়ি চলাচল বন্ধ রেখে ধর্মঘট পালন করছি।'
মাওনা হাইওয়ে থানার উপ পরিদর্শক (এসআই) মো. খোরশেদ আলম বলেন, শ্রমিক নেতারা মহাসড়কের কোনো কোনো জায়গায় অবরোধ করেছিল। খবর পাওয়া মাত্র সেসব জায়গা থেকে অবরোধ সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আপাতত যান চলাচলে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে কোনো সমস্যা নেই।
সিলেট বিভাগের সব রুটে শুক্রবার ভোর থেকে যাত্রীবাহী বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। কয়েকটি রুটে যানবাহন চললেও বেশিরভাগ রুটে যানচলাচল বন্ধ থাকায় জনভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে।
বাস না থাকায় সকাল থেকে সিলেট রেল স্টেশনে যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড় দেখা দিয়েছে বলে জানিয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ। সকালে ঢাকা ও চট্টগ্রামগামী ট্রেন অতিরিক্ত যাত্রীবোঝাই হয়ে ছেড়ে গেছে বলে রেল স্টেশন সূত্রে জানা গেছে।
সিলেট রেলওয়ে স্টেশনের ব্যবস্থাপক খলিলুর রহমান বলেন, 'যাত্রীবাহী বাস বন্ধ থাকায় ট্রেনের টিকিটের জন্য লম্বা লাইন দেখা দিয়েছে। অনেকে অনলাইনেও টিকেট কিনছেন।'
অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে নগরীর কদমতলী বাস টার্মিনাল ও হুমায়ুন রশীদ চত্ত্বরসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
কদমতলী বাস স্টেশন থেকে শহরে ফিরতে থাকা যাত্রী মোহাম্মদ তোয়াহা বলেন, 'জরুরি প্রয়োজনে গ্রামের বাড়ি মৌলভীবাজারের বড়লেখায় যাওয়ার জন্য কদমতলী বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে জানতে পারি আজ বাস ধর্মঘট। বিকল্প বাহনে ভাড়া কয়েকগুণ বেশি চাওয়ায় ঘন্টাখানেক অপেক্ষার পর বাসায় ফিরে যাচ্ছি।'
পরিবহন ধর্মঘটের প্রসঙ্গে সিলেট জেলা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম বলেন, 'পরিবহন ব্যবসা করোনাকালে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যখন সব স্বাভাবিক হয়েছে, তখনই জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু ভাড়া বাড়ানো হয়নি। তাই আমাদের দাবি হয় তেলের দাম কমাতে হবে, নয়তো ভাড়া বাড়াতে হবে। আপাতত আগামী ৪৮ ঘন্টা ধর্মঘট চলবে। দাবি আদায় না হলে কঠোর আন্দোলন হবে।'
বাস ধর্মঘটের সঙ্গে যোগ দিয়ে বিভিন্ন দাবিতে ধর্মঘট শুরু করেছে পণ্যবাহী ট্রাক সংগঠনের নেতারা। ফলে সকাল থেকে সিলেটের কাঁচাবাজারে এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
সিলেট জেলা ট্রাক পিকআপ কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক শাব্বীর আহমেদ ফয়েজ বলেন, 'ভোর থেকে অনির্দ্দিষ্টকালের জন্য পণ্যবাহী ট্রাকের ধর্মঘট শুরু হয়েছে। সিলেটের লামাকাজী ব্রিজসহ বিভিন্ন সেতুতে অপ্রয়োজনীয় ও অতিরিক্ত টোল আদায়, চাঁদাবাজি ও পুলিশী হয়রানিসহ বিভিন্ন দাবিতে আমাদের এই ধর্মঘট।'
পটুয়াখালী-বরিশাল মহাসড়কের লেবুখালী এলাকায় কিছু দিন আগে উদ্বোধন হওয়া পায়রা ব্রিজে অতিরিক্ত টোল র্নিধারণ ও জ্বালানী তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে বাস ভাড়া বাড়ানোর দাবিতে পটুয়াখালীর সকল রুটে অনির্দিষ্টকালের জন্য বাস চলাচল বন্ধ করা হয়েছে।
শুক্রবার সকাল ৬টা থেকে জেলার অভ্যন্তরীণ ও দূরপাল্লার সকল বাস চলাচল বন্ধ হওয়ায় কুয়াকাটার পর্যটকসহ যাত্রীরা দুর্ভোগে পড়েছেন।
ঢাকা থেকে লঞ্চে করে আসা যাত্রীরা বাস ধর্মঘটের কারণে নিজ নিজ গন্তব্যে পৌঁছাতে দুর্ভোগে পড়েন। যাত্রীরা অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে রিকশা, অটো রিকশায় চলাচল করছেন।
পটুয়াখালী জেলা বাস-মিনি বাস মালিক সমিতির সভাপতি রিয়াজ উদ্দিন বলেন, 'গত ২৪ অক্টোবর পায়রা সেতু যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ওই সেতুতে ফেরির তুলনায় তিন থেকে পাঁচ গুণ বেশি টোল নির্ধারণ করা হয়েছে। তাছাড়া সম্প্রতি ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটার প্রতি ১৫ টাকা বাড়ানো হয়েছে। এতে আমাদের পরিবহন ব্যবসা লোকসানের মুখে পড়েছে। এ মুহুর্তে ভাড়া না বাড়ানো পর্যন্ত আমরা অনির্দিষ্টকালের জন্য জেলার সব রুটে বাস চলাচল বন্ধ রেখেছি।'