বৈশ্বিক প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশকে এগিয়ে নিতে বিজ্ঞানী ও গবেষকদের প্রতি আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন তাঁর সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া। তিনি বৈশ্বিক নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলাতে বিজ্ঞানী ও গবেষকদের আন্তরিক প্রচেষ্টা দেখতে চান।
শেখ হাসিনা আজ বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফেলোশিপ ও গবেষণা অনুদান প্রদান অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন। তিনি ফেলোশিপ ও গবেষণা সহায়তা গ্রহীতাদের জাতির সার্বিক উন্নয়নে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার দেশের ৮টি বিভাগেই শিক্ষার্থীদের মেধা ও মননের বিকাশে বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার প্রতিষ্ঠা করবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সকল বিভাগীয় শহরে বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার আমরা স্থাপন করবো। তিনি বলেন, আমাদের ৮টি বিভাগ এবং ৮টি বিভাগেই যেন নভোথিয়েটার হয়, যাতে আমাদের ছেলে-মেয়েরা আরো ভাল শিক্ষা নিতে পারে এবং জ্ঞান অর্জন করতে পারে।’
ইতোমধ্যে ৪/৫টি বিভাগে নভোথিয়েটার স্থাপনের প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
সরকার প্রধান আজ সকালে ‘বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফেলোশিপ’, ‘এনএসটি ফেলোশিপ’ প্রাপ্তদের মাঝে চেক প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি’র ভাষণে এ সব কথা বলেন।
তিনি তাঁর সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন।
ফেলোশিপ এবং গবেষণা অনুদান প্রাপ্তদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের মানুষের দেয়া রাজস্ব থেকে আপনাদের ফেলোশিপ এবং গবেষণা অনুদান প্রদান করা হচ্ছে। কাজেই যারা ফেলোশিপ পাচ্ছেন আপনাদেরকেও সর্বোচ্চ শ্রম এবং দায়বদ্ধতা নিয়ে জাতীয় উন্নয়নে কাজ করতে হবে। কারণ, আমরা চাই দক্ষ মানব শক্তি গড়ে তুলতে।
শেখ হাসিনা বলেন, নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মাধ্যমে বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়েই আমাদের চলতে হবে। আমাদের অর্থনীতি কৃষিনির্ভর। কাজেই এই কৃষিকে যেমন যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে উন্নত করতে হবে, পাশাপাশি শিল্পায়ন ও আমাদের দরকার।
৪র্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য দক্ষ মানব সম্পদ গড়ে তোলার ওপর গুরুত্বারোপ করে সরকার প্রধান বলেন, শিল্পায়নের ক্ষেত্রে ৪র্থ শিল্প বিপ্লব আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে। তার জন্য উপযুক্ত দক্ষ মানব শক্তিও আমাদের গড়ে তুলতে হবে এবং সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমরা আপনাদের সহযোগিতা করে যাচ্ছি।
সরকার প্রধান বলেন, দেশের মানুষ যাতে আপনাদের কাছ থেকে সহযোগিতা পায় সেটাই আমরা চাই। আপনাদের উদ্ভাবনী জ্ঞানের ব্যবহারিক প্রয়োগ যেন মানুষের কল্যাণে হয়। কাজেই যারা আজকে গবেষণা করছেন সেই গবেষণার কী ফলাফল হলো- সেটাও আমি দেখতে চাই।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি মনে করি এই মেধাকে কাজে লাগিয়েই আমরা এগিয়ে যেতে পারবো। অর্থনৈতিকভাবে আমরা এখন যথেষ্ট শক্তিশালী। কিন্তু আরো সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী স্থাপতি ইয়াফেস ওসমান, বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, বিজ্ঞানী, গবেষক এবং বিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের মধ্যে ‘বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফেলোশিপ’,‘এনএসটি ফেলোশিপ’ এবং ‘বিশেষ গবেষণা অনুদান’ প্রদান করেন।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী স্থাপতি ইয়াফেস ওসমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব জিয়াউল হাসান স্বাগত বক্তৃতা করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার দেশে-বিদেশে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ক্ষেত্রে এমইএস, এমফিল ও পিএইচডি প্রোগ্রামের জন্য বঙ্গবন্ধু ফেলোশিপ প্রদান করছে। ২০১০-১১ অর্থবছর থেকে বর্তমান পর্যন্ত ৫৯৬ জনকে ২২৫ কোটি ৮২ লক্ষ টাকা দিয়েছে।
তা ছাড়া এমইএস, এমফিল, পিএইচডি পর্যায়ে জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফেলোশিপ প্রদান করা হচ্ছে। ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে সরকার এখন পর্যন্ত ২২ হাজার ২২০ জন ছাত্র-ছাত্রী ও গবেষকদের মধ্যে ১৩৭ কোটি ৫৩ লাখ টাকা প্রদান করেছে।
ফেলোশিপের পাশাপাশি বিজ্ঞানী ও গবেষকদের মধ্যে বিশেষ অনুদান প্রদানের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা গত ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে চলতি অর্থবছর পর্যন্ত ৫ হাজার ২০টি প্রকল্পের অনুকূলে ১৭৮ কোটি ৯৩ লাখ টাকা প্রদান করেছি।
তিনি বলেন, ’৪১ সালের মধ্যে দেশকে উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তোলার কাজে সকলকে মনোনিবেশ করতে হবে। কীভাবে ধাপে ধাপে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে সেদিকেই আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে। আর সে জন্য সকলেই অন্তত কিছুটা হলেও যেন প্রযুক্তি জ্ঞান সম্পন্ন হতে পারে, সেটাই আমাদের লক্ষ্য।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা হাইটেক সিটি, হাইটেক পার্ক, সফটওয়্যার প্রযুক্তি পার্ক প্রতিষ্ঠা করে যাচ্ছি। প্রত্যেক উপজেলায় কারিগরি শিক্ষার উদ্যোগের পাশাপাশি প্রযুক্তি শিক্ষার জন্য প্রতিটি জেলা-উপজেলায় আরো যা যা দরকার আমরা তা করে যাচ্ছি।
তিনি বলেন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষা জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে ৪৯২টি উপজেলায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্লাব গঠন করেছি। আমাদের সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশ শিল্প ও বিজ্ঞান গবেষণা পরিষদ গত ১৩ বছরে ২১১টি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। ৯৪টি প্রযুক্তি বাণিজ্যিকীকরণের জন্য হস্তান্তর করা হয়েছে। ৯১টি প্রযুক্তি পেটেন্ট অর্জন করেছে, ৯৫টি পেটেন্ট’র জন্য আবেদন করা হয়েছে, ২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন রুপপুর পরমানু বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। পাশাপাশি দক্ষিণাঞ্চলে আরেকটি পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র করার জন্য জায়গা খোঁজা হচ্ছে। ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ উৎক্ষেপণ করা হয়েছে এবং দ্বিতীয় স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের পরিকল্পনা চলছে।
সরকার প্রধান বলেন, জেনমিক গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, হাইড্রোজেন শক্তি গবেষণাগার, জাতীয় জিন ব্যাংক স্থাপনের কাজ অতিদ্রুত সম্পন্ন হবে। মলিকিউলার গবেষণাগার স্থাপনেরও আমরা পদক্ষেপ নিয়েছি।
দেশের বিজ্ঞান শিক্ষা ও চর্চার সম্প্রসারণে বিভিন্ন আইন ও বিধিমালা প্রণয়ন ও যুগোপযোগী করার যে পদক্ষেপ সরকার নিয়েছে তারও উল্লেখ করেন তিনি।
মার্চ মাস আমাদের স্বাধীনতার মাস উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী এ মাসেই জাতির পিতার নেতৃত্বে সারাদেশে পরিচালিত অসহযোগ আন্দোলন, ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ এবং ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদানের ঘটনাবলীর নানা ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ পুণর্গঠনকালে জাতির পিতা শিক্ষাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে মাত্র ন’মাসেই একটি সংবিধান প্রণয়ন করেছিলেন। তিনি ৩৬ হাজার ১৬৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেন এবং ১৯৭৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন প্রতিষ্ঠা করেন।
তাঁর সরকারের মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই যে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল, পরমানু বিদ্যুৎ কে›ন্দ্র অথবা পদ্মা বহুমুখী সেতুর মতো বড় বড় প্রজেক্ট গুলোতে আমাদের বহু ইঞ্জিনিয়ার থেকে শুরু করে বহু কর্মীরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করে যাচ্ছে। এর মাধ্যমে আমি মনে করি আমাদের দক্ষ জনবলও সৃষ্টি হচ্ছে।
শেখ হাসিনা বলেন, আজকে আমরা উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছি। আমাদের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়েছে, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি, করোনাকালেও ভালো প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারছি। অর্থনৈতিক ভাবে আমরা যথেষ্ট শক্তিশালী হতে পেরেছি।
এ সময় খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণতা অর্জনের বিষয়ে বিএনপি’র সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের একটি বক্তব্য-‘খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা ভাল নয়, তাহলে বিদেশি সাহায্য পাওয়া যাবেনা’র উদ্ধৃতি তুলে ধরে এ ধরনের মানসিকতার তীব্র সমালোচনা করেন তিনি।
তিনি বলেন, এখন আর কারো কাছে আমাদের হাত পেতে চলতে হয় না। আমাদের বার্ষিক উন্নয়নের ৯০ শতাংশ এখন নিজেদের অর্থায়নে করতে পারি।
আমেরিকা ওয়ার্ল্ড ব্যাংককে দিয়ে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধ করে দিলে আমরা সেটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের মাধ্যমে সেটা প্রমাণ করেছি, বলেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে সার্বিক গবেষণার ওপর গুরুত্বারোপ করে চিকিৎসা শাস্ত্রে গবেষণা বাড়ানোর ওপর জোর দেন।
তিনি বলেন, গবেষণা না হলে আজকে আমরা দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে বা এতো উন্নতি করতে পারতাম না। এ জন্য গবেষণাকে আমি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেই। বিশেষ করে বিজ্ঞান এবং চিকিৎসা শাস্ত্রের গবেষণাকে। মেডিকেলের ক্ষেত্রে আমাদের গবেষণা একটু কম, কাজেই এ ক্ষেত্রে আরো গবেষণা বাড়াতে হবে। আর এই গবেষণাই পারে আমাদের দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। সবাইকে টিকা গ্রহণের আহবান পুণর্ব্যক্ত করে স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি মেনে চলার কথাও স্মরণ করিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, তাঁর সরকার কভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আনতে পেরেছে এবং দেশের প্রায় ৭০ শতাংশের কাছাকাছি মানুষ ইতোমধ্যে টিকা পেয়েছে। কিন্তু টিকা সবাইকেই নিতে হবে। অতীতে অনীহা থাকলেও এখন টিকা নিয়ে মানুষের মাঝে আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে। আর স্কুল-কলেজ আমরা খুলে দিয়েছি, সবকিছু স্বাভাবিকভাবেই চলবে। তবে, সুরক্ষা একান্তভাবে দরকার। সেটা আমরা করবো।
শেখ হাসিনা বলেন, তাঁর সরকার ১২ বছর বয়সীদের বা তদুর্ধদের পর্যন্ত টিকা দিচ্ছে। এর থেকে অল্প বয়সেও টিকা দেয়া যায় কি-না সেই অনুমতির জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছে আবেদন করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার মনে হয় এই অনুমোদন পেলে তখন আমরা সকলকে টিকা দিতে পারবো। অন্তত ৭, ৮ বছর বা ১০ বছর বয়সীদের যদি দিতে পারি তাহলে আমাদের প্রাইমারীতে আর কোন অসুবিধা হবে না।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ একটি ব-দ্বীপ, এই ব-দ্বীপটা যাতে জলবায়ুর অভিঘাত থেকে রক্ষা পায় এবং আগামী প্রজন্ম যেন সুন্দর জীবন পেতে পারে সে জন্যই তাঁর সরকার ‘ডেল্টা প্ল্যান-২১০০’ প্রনয়ণ ও বাস্তবায়নের উদোগ নিয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘২০৪১ প্রেক্ষিত পরিকল্পনা’ আর ও ‘ডেল্টা প্ল্যান-২১০০’ এর কাঠামো তৈরি করে দিয়েছি। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে এগুলো সংশোধন করে এর ওপর ভিত্তি করে যদি পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে পারি তাহলে বাংলাদেশের মানুষকে আর কেউ কোন দিন ‘দাবায়ে রাখতে পারবেনা’।
তিনি বলেন, আত্মবিশ্বাস হচ্ছে সবচেয়ে বড় জিনিষ। আত্মবিশ্বাস নিয়ে চলতে পারলে, যে কোন অসাধ্য কাজকেও সাধন করা যায় সেটা আমার বিশ্বাস। সুত্র-বাসস।