বাঙালি মাথা নিচু করে না ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান বিশ্বকে এ বার্তাই দেয়
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দেশের সকল অর্জনের মূলে থাকা ‘জয় বাংলা’কে তাঁর সরকার জাতীয় শ্লোগান ঘোষণার মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বকে এই বার্তাই পৌঁছে দিতে চেয়েছে যে, বাঙালি মাথা নিচু করে নয় বরং মাথা উঁচু করেই চলবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই জয় বাংলা শ্লোগানটা আজ সকলের হয়েছে এবং এই শ্লোগানের মধ্য দিয়ে আমরা এটাই বিশ্বের মানুষের কাছে পৌঁছাতে চাই- আমরা বিজয়ী জাতি, আমরা বিজয় অর্জন করেছি, মাথা নত করে আমরা চলিনা, মাথা নত করে চলবোনা, বিশ্ব দরবারে বাঙালি মাথা উঁচু করেই চলবে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল রাতে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের মূল উদ্দীপক শ্লোগান ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় শ্লোগান হিসেবে ঘোষণা উপলক্ষ্যে আয়োজিত ‘জয় বাংলা উৎসব’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন।
তিনি গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রাজধানীর বনানীস্থ হোটেল শেরাটনে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) আয়োজিত অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন।
শেখ হাসিনা তাঁর অন্যতম একটা শক্তি ’৭৫ এর বিয়োগান্তক ঘটনায় বেঁচে যাওয়া তাঁর একমাত্র ছোটবোন শেখ রেহানার কথা উল্লেখ বলেন, আমরা দুজনেই আজকে সব থেকে বেশি খুশি। কারণ এই জয় বাংলা শ্লোগান এদেশের মানুষকে নিজের জীবনটা বিলিয়ে দিয়ে দেশকে বিজয়ের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে সহযোগিতা করেছে। যে শ্লোগান দিয়ে এদেশের মানুষ রক্তের অক্ষরে লিখে গেছে-আমি বিজয় আনতে চাই। বাংলাদেশের জয় হবে। আজকে সেই জয় বাংলা আমাদের সকলের, এদেশের মানুষের, বিজয়ী জাতির বাঙালি জাতির, আমাদের মাথা উঁচু করে চলার এ শ্লোগান। এই শ্লোগান ধারণে তিনি সকলকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, কোন ত্যাগ যে বৃথা যায়না আজকে সেটাই প্রমাণ হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান ফজলুর রহমান এবং বিএবি চেয়ারম্যার মো. নজরুল ইসলাম মজুমদার অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে ‘মুক্তিদাতা শেখ মুজিব’ নামের একটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ ১৯৭১ রেসকোর্সের ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দি উদ্যান) প্রদত্ত তাঁর ঐতিহাসিক কালোত্তীর্ণ ভাষণ সমাপ্ত করেছিলেন ‘জয় বাংলা’ উচ্চারণ করে। সেই থেকে এটি মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী কোটি কোটি জনতার প্রাণের শ্লোগানে পরিনত হয়। নিরস্ত্র বাঙালির অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে বিজয় ছিনিয়ে আনার অনুপ্রেরণা হয়ে যায় ‘জয় বাংলা’। বঙ্গবন্ধু কন্যা এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানান, কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা থেকেই বঙ্গবন্ধু এই ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি নিয়েছিলেন।
একটি রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ১০ মার্চ ‘জয় বাংলা’ স্লোগানকে বাংলাদেশের জাতীয় স্লোগান হিসেবে গ্রহণের জন্য হাইকোর্ট রায় প্রদান করেন। ২০২২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং ২ মার্চ ২০২২ ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান ঘোষণা করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ প্রজ্ঞাপন জারি করে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জয় বাংলা শ্লোগান এক সময় বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল যেটা অত্যন্ত দু:খজনক। তবে, হ্যাঁ আমরা আওয়ামী লীগ যাঁরা করি আর বঙ্গবন্ধুর আদর্শ যাঁরা আমরা ধরে রেখেছি, যারা এদেশের স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করে এবং মুক্তিযোদ্ধারা- তাঁরা এটা ধরে রেখেছিল। বাধা এসেছে, অনেক সময় অনেক কটুক্তি -সমালোচনা শুনতে হয়েছে। কিন্তু তারপরেও আমরা এই সত্যটাকে ধরে রাখতে পেরেছিলাম বলেই আজকে এটা জাতীয় ভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
তিনি বলেন, জয় বাংলা শ্লোগান আমাদের মুক্তি সংগ্রামের শ্লোগান। জয় বাংলা শ্লোগান মুক্তিযুদ্ধের শ্লোগান। জয় বাংলা শ্লোগান আত্মত্যাগের শ্লোগান। জয় বাংলা শ্লোগান আমাদের অর্জনের শ্লোগান। যে শ্লোগানের মধ্যদিয়েই আমরা বিজয় অর্জন করেছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর সারাটা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন বাংলাদেশের মানুষের জন্য। যে মানুষগুলো ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত ছিল।
তিনি বলেন, জাতির পিতা যখন ৬ দফা দিলেন ঠিক তাঁর আগেই ছাত্রলীগকে এই জয়বাংলা শ্লোগানটাকে মাঠে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। এর অন্তর্নিহিত অর্থ একটাই ছিল- সংগ্রামের মধ্যদিয়ে মানুষের মাঝে স্বাধীনতার চেতনাটাকে জাগ্রত করা এবং এই শ্লোগানের মধ্য দিয়েই আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন। যাঁর প্রতিটি পদক্ষেপ জাতির পিতা নিয়েছিলেন অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে।
আমাদের স্বাধীনতার প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করে ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানের মাহাত্ম তুলে ধরতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতার ৭ মার্চের যে ভাষণ, সেই ভাষণও তিনি শেষ করেন ‘জয় বাংলা’ বলে। অর্থাৎ বাঙালির যে বিজয় হবে সে সম্পর্কে তিনি সম্পূর্ণ নিশ্চিত ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুর মোকাবিলা করতো এই জয় বাংলা শ্লোগান দিয়ে। এই শ্লোগান প্রতিটি মুিক্তকামী মানুষকে অনুপ্রাণিত করতো।
জাতির পিতার দূরদর্শিতাই ছিল আমাদের সকল অর্জনের মূল শক্তি উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা স্বাধীনতার পর মাত্র সাড়ে ৩ বছর সময় পেয়েছিলেন সে সময়ে একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশকে তিনি গড়ে তুলে স্বল্পোন্নত দেশের পর্যায়ে এনে রেখে যান। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো আমাদের মুক্তি সংগ্রামের সময় যে অপপ্রচার ছিল স্বাধীনতা অর্জনের পরও সেটা থেমে থাকেনি। অর্থাৎ স্বাধীনতা বিরোধীদের চক্রান্ত সবসময় ছিল। যখন অনেক ষড়যন্ত্র করেও মানুষের হৃদয় থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছতে পারেনি তখনই চরম আঘাত এলো ’৭৫ এর ১৫ আগস্ট।
তিনি বলেন, ’৭৫ এর ১৫ আগষ্টের পর যে শ্লোগান একদিন এদেশের মানুষকে স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছিল একটি গেরিলা যুদ্ধে অনুপ্রাণিত করেছিল, পাকিস্তানীদের বর্বর নির্যাতনও যে শ্লোগানকে একদিন থামাতে পারেনি সে শ্লোগান নিষিদ্ধ হয়ে গেল। ’৭৫ এর ১৫ আগস্ট আমরা আপনজন হারিয়েছি, আর দেশের জনগণ তাঁদের সকল সম্ভাবনাকেই হারিয়ে ফেলল।
সরকার প্রধান বলেন, আমাদের কাজটা হচ্ছে জনগণের সেবা করা আর দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প সবকিছু যেন সহজভাবে চলতে পারে সে সুযোগটা করে দেয়া, সেটাই আমরা করে দিচ্ছি। আমরা ১শ’ অর্থনৈতিক অঞ্চল করে দিচ্ছি যেখানে দেশি বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে মানুষের কর্মসংস্থান হবে এবং অর্থনীতি আরো শক্তিশালী ও মজবুত হয়ে উঠবে এবং মানুষের ক্রয় ক্ষমতাও বাড়বে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার তৃণমূলকে লক্ষ্য ধরেই দেশের উন্নয়ন করে যাচ্ছে। তিনি ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্য বলেন, জনগণের ক্রয় ক্ষমতা যত বাড়বে ততই আপনাদের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত হবে।
এ সময় বেসরকারি খাতকে উন্মুক্ত করে দেয়ায় তাঁর সরকারের পদক্ষেপের উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ওয়ার্ল্ড ব্যাংক আমাকে বলেছিল এতগুলো বেসরকারি ব্যাংক দিয়ে কি হবে, বাংলাদেশের অর্থনীতিতো খুব ছোট’ কিন্তু এটা ছোট থাকবে না বরং একদিন যে বড় হবে সে আশাবাদই তিনি তখন ব্যক্ত করেছিলেন বলে জানান।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে বেসরকারি ব্যাংকের আর শাখা খোলার সুযোগ না দিয়ে সরকারি ব্যাংকের অনেক শাখা বন্ধ করে দেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছিল। এমনকি আমাদের সরকারি বাস চলাচল করবে সেখানেও বাধা দেয়া এবং সেটাও বন্ধ করার প্রচেষ্টা হয়েছিল।
তিনি বলেন, ’৭৫ পরবর্তী সরকারগুলো এতই দুর্বল ছিল যে আন্তর্জাতিক সংস্থা যাই পরামর্শ দিত তাই তারা মেনে চলতো। নিজেদের কোন চিন্তা চেতনা বা পরিকল্পনা ছিলনা। কিন্তু আমি সরকারে আসার পর থেকে ঐসব পরামর্শ শুনি নাই।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি শুধু একটা কথা বলেছি এই দেশ আমাদের। আমরা এ দেশ স্বাধীন করেছি। আমাদের এদেশের মানুষের মঙ্গল কিসে হবে আমরাই তা সবথেকে ভাল করে জানি। যেটা দেশের জন্য মঙ্গলজনক সেটাই আমরা করবো।
শেখ হাসিনা বলেন, আজকে ব্যাংক, বীমা থেকে শুরু করে বেসরকারি টেলিভিশন, বেসরকারি রেডিও, সকলের হাতে মোবাইল ফোন, ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত ব্রডব্যান্ড পৌঁছে দেয়া সহ ডিজিটাল বাংলাদেশ আমরা গড়ে তুলেছি এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে সক্ষম হয়েছি।
ব্যাংক ব্যবস্থাকে তৃণমূলে মানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়ায় তাঁর সরকারের উদ্যোগ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকে মাত্র ১০ টাকায় একজন কৃষক একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারে এবং তাঁদের ভতুর্কির টাকাটাও ব্যাংকের মাধ্যমেই তাঁদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। আমাদের লক্ষ্য কোন মানুষ ক্ষুধার্ত বা গৃহহীন আর থাকবে না। সুত্র-বাসস।