১৫ বছরের সাংবাদিকতা নিয়ে প্রতিবেদন লিখতে জাতিসংঘের সহায়তা চাইব : প্রেস সচিব শফিকুল আলম

মিথ্যা ও অপতথ্য ছড়িয়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা চলছে উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, জাতিসংঘ জুলাই-আগস্ট গণহত্যা নিয়ে একটি স্বচ্ছ ও চমৎকার প্রতিবেদন দিয়েছে। গত ১৫ বছরের সাংবাদিকতা নিয়ে এমন একটি প্রতিবেদন যেন করা হয়, সে বিষয়ে বাংলাদেশ খুব শীঘ্রই জাতিসংঘের সহায়তা চাইবে যাতে জুলাই-আগস্ট ছাত্র গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত গণহত্যার উপর দেয়া প্রতিবেদনের মত গণমাধ্যমের সার্বিক ভূমিকার উপর প্রতিবেদন দেয়া হয়।
তিনি বলেন, “জাতিসংঘকে অনুরোধ করা হবে- বিশেষজ্ঞ একটি প্যানেল করে গত ১৫ বছরের তিনটি নির্বাচন, আইসিটির রায়ে ফাঁসি, মাওলানা সাঈদীর মামলার রায়ের পর সারা দেশে সংঘটিত ঘটনায় প্রাণহানি, শাপলা চত্বর ট্র্যাজেডিসহ সব বড় বড় ঘটনাগুলোতে কেমন সাংবাদিকতা হয়েছে, সাংবাদিকদের ভূমিকা কেমন ছিল, তা অনুসন্ধান করে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করতে।”
শুক্রবার (০২ মে) চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের জুলাই বিপ্লব স্মৃতি হলে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়ন আয়োজিত ‘জুলাই বিপ্লব পরবর্তী বাংলাদেশ: গণমাধ্যমের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব এসব কথা বলেন।
চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব অন্তর্বর্তী কমিটির সদস্য সচিব জাহিদুল করিম কচি’র সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ওবায়দুর রহমান শাহীন, মহাসচিব কাদের গনি চৌধুরী। ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন প্রধান উপদেষ্টার ডেপুটি প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার।
প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, জাতিসংঘকে অনুরোধ করা হবে- বিশেষজ্ঞ একটি প্যানেল করে গত ১৫ বছরের তিন নির্বাচনসহ সব বড় বড় ঘটনাগুলোতে কেমন সাংবাদিকতা হয়েছে, সাংবাদিকদের ভূমিকা কেমন ছিল, তা অনুসন্ধান করে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করতে।
জুলাই আন্দোলনের সময় চট্টগ্রামে সাংবাদিকরা আন্দোলনকারীদের পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার বিষয়টি বারবার উঠে আসে আলোচনা সভায়। এবিষয়ে প্রেস সচিব বলেন, এ ঘটনার তদন্ত হওয়া উচিত। সাংবাদিক ইউনিয়ন ও প্রেস ক্লাবের উচিত একজন বিচারক, পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়ে একটি বিশেষজ্ঞ তদন্ত কমিটি গঠন করে বিষয়টি খোলাসা করা। এটি বহু আগেই করা প্রয়োজন ছিল। যারা এগুলো করেছে তাদের আইনের আওতায় আনা উচিত। আন্দোলন ব্যর্থ হলে এই সাংবাদিকরা ছাত্রদের কী করতো, আপনারা দেখতেন।
অতীতের যেকোনও সময়ের চেয়ে দেশের মানুষ বর্তমানে সবচেয়ে বেশি মত প্রকাশের স্বাধীনতা উপভোগ করছে উল্লেখ করে শফিকুল আলম বলেন, এখন মানুষ মন খুলে লিখছেন, সমালোচনা করছেন, গালিও দিচ্ছেন। কাউকে কিছু বলা হচ্ছে না। অনেকে আবার বলছেন, স্বৈরাচারের দোসরদের প্রতি সফ্ট হচ্ছি। কিন্তু আমরাতো আইনের বাইরে গিয়ে কিছু করতে পারি না। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর প্রধান উপদেষ্টা সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠক করে বলেছেন, ‘আপনারা লিখুন। মন খুলে লিখুন। আমরা কোনও কলম ভেঙ্গে দেইনি, কোনো প্রেসে তালা দেইনি। কোনো গণমাধ্যম যদি তার কর্মীকে চাকরিচ্যুত করে, আপনারা সেই গণমাধ্যম অফিসের সামনে গিয়ে প্রতিবাদ করুন’।
তিনি বলেন, সামনে নির্বাচন। আমাদের গণমাধ্যমকে এগুলোর জন্য প্রস্তুত হতে হবে। এটি শুধু সরকারের একার দায়িত্ব নয়। প্রত্যেকটি পত্রিকার ফ্যাক্ট চেকিং সেল থাকা দরকার। এটি পোস্ট রেভ্যুলেশনারী চ্যালেঞ্জ।
ভারতীয় গণমাধ্যম প্রসঙ্গে প্রেস সচিব বলেন, ভারতীয় গণমাধ্যম ও আওয়ামী লীগের লোকজন একত্রিত হয়ে এসব অপতথ্য ছড়াচ্ছে। তারা মিলিয়ন বিলিয়ন ডলার-টাকা নিয়ে বসে আছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে তারা আরও মিথ্যা তথ্য ছড়াবে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব কাদের গনি চৌধুরী বলেন, আমরা দেখেছি শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলনে আমাদের কিছু সাংবাদিক প্রশ্ন করতো, প্রশ্নগুলো দেখলেই মনে হতো তারা দালালি আর চামচামি করছেন। আমরা তো এমন সাংবাদিকতা চাইনি। স্বৈরাচারের দোসররা যেন আর মাথাচাড়া দিয়ে না উঠতে পারে সেদিকে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে।
তিনি আরও বলেন, স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য নিরাপদ ও স্বাধীন পরিবেশ অত্যন্ত জরুরি। স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য সংবাদ মাধ্যমগুলোর নিরপেক্ষ মনোভাব খুব বেশি দরকার। সাংবাদিক সুরক্ষা আইন এখনো কার্যকর হয়নি। দ্রুত যেন এ আইন কার্যকর হয়। বাংলাদেশে সাংবাদিকতার এখন বড় যে সংকট সেটি হলো আস্থার সংকট। সাংবাদিকতায় যে আস্থা ছিল, গত সতের বছরে সেটি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। এখন একটি সুন্দর সময় এসেছে। সংবাদ মাধ্যমের প্রতি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। এদেশের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা, আর কারো প্রতি সাংবাদিকরা দায়বদ্ধ নয়। যদি সাংবাদিকরা অন্যের প্রতি দায়বদ্ধ থাকেন তাহলে সেটি আর সাংবাদিকতা থাকে না। সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলতে হবে।
প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার আলোচনা সভার ধারণাপত্র উপস্থাপনকালে আগামী সপ্তাহেই উপদেষ্টা পরিষদের সভায় নতুন সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট অনুমোদনের সম্ভাবনার কথা জানিয়ে বলেন, বিগত বছরগুলোতে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করেছে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট, যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচিত হওয়ার পর মৌলিক কোনো পরিবর্তন ছাড়াই ‘সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট’ নামে পুনঃপ্রকাশিত হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই আইন বাতিলের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ আইনের অধীনে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে করা সব মামলা বাতিল করা হয়েছে এবং নতুন করে আর কোনো মামলা করা হয়নি।
তিনি বলেন, আমরা আশা করছি, আগামী সপ্তাহে উপদেষ্টা পরিষদের সভায় নতুন সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট অনুমোদিত হবে। প্রস্তাবিত আইনে আগের আইনের ৯টি নিবর্তনমূলক ধারা বাদ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, যেগুলোর আওতায় ৯৫ শতাংশ মামলা হয়েছিল। এসব ধারা বাতিল হলে ওই মামলাগুলোও স্বয়ংক্রিয়ভাবে খারিজ হয়ে যাবে।
প্রস্তাবিত আইনে গুরুতর সাইবার হ্যাকিং ছাড়া অন্য অপরাধে পরোয়ানা ছাড়া গ্রেফতারের বিধান বাতিল করা হচ্ছে উল্লেখ করে আবুল কালাম আজাদ বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিশ্বাস করে, এ আইন হলে সাংবাদিকদের হয়রানি অনেকটা কমে আসবে। দেশে মুক্ত সাংবাদিকতার পরিবেশ সৃষ্টিতে এটি হবে একটি বড় অগ্রগতি।
আলোচনা সভায় আরও বক্তৃতা করেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি মোহাম্মদ শাহ্ নওয়াজ, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নসরুল কাদির, চবি যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শহীদুল্লাহ লিপন, চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এডভোকেট আব্দুস সাত্তার, এ্যাব চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার সেলিম মো. জানে আলম, কমনওয়েলথ জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ওসমান গণি মনসুর, বাংলাদেশ সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদ চট্টগ্রামের সদস্য সচিব ডা. খুরশীদ জামিল, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সদস্য সাংবাদিক মিয়া মোহাম্মদ আরিফ, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের যুগ্ম মুখ্য সংগঠক রিজাউর রহমান, জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য নীলা আফরোজ, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সিয়াম ইলাহী ও রিদুয়ান সিদ্দিকী প্রমুখ।