গণপূর্ত অধিদপ্তর : ১৯ কোটি টাকার কাজের বিল ২৯ কোটি টাকা
গণপূর্ত অধিদপ্তরের অধীনে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেস ও হাসপাতালের সম্প্রসারণের নির্মাণ কাজে ‘মেসার্স জিকে বিল্ডার্স-পায়েল’ নামের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটিকে তার কাজের অধিক প্রায় ১০ কোটি ৪৫ লক্ষ টাকা দেওয়া হয়। কাজটি যখন চলছিল সে সময় শেরে বাংলা নগর গণপূর্ত বিভাগ-১ নির্বাহী প্রকৌশলী হিসাবে দায়িত্বে ছিলেন মোহাম্মদ ফজলুল হক। যিনি বর্তমানে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (উন্নয়ন) হিসেবে অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত আছেন। গণপূর্ত অধিদপ্তরের সূত্রগুলো বলছে, দোষীদের বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যাবস্থা নেওয়া হবে।
জানাগেছে, হাসপাতালটিতে কাজের সাথে জড়িত ক্যাসিনো কান্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত ও আলোচিত ঠিকাদার জি কে শামীমের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ‘মেসার্স জিকে বিল্ডার্স-পায়েল’। এটি একটি জয়েন্ট ভেঞ্চার প্রতিষ্ঠান।
প্রকৌশল নিউজের অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৮ সালের ৮ অক্টোবর মেসার্স জিকে বিল্ডার্স-পায়েল নামের প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ প্রদান করা হয়। সেখানে বলা হয়, হাসপাতালের সম্প্রসারণের এই নির্মাণ কাজের প্রকল্পের আওতায় ১৫ তলা ফাউন্ডেশনসহ ১২ তলা হাসপাতাল ভবন নির্মাণের জন্য দরপত্রের সব প্রক্রিয়া শেষ করা হয়।
সেই সাথে, ২৮ অক্টোবর ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটিকে তাদের কাজের জন্য সাইটের পজেশন হস্তান্তর করা হয়। পরবর্তিতে, কাজটির জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করা হয় একই বছরের ৪ নভেম্বর। সেখানে কাজের চুক্তি মূল্য ছিল প্রায় একশত ৬৮ কোটি টাকা, যার মেয়াদ ছিল ২ বছর। সেবছরের ৮ ডিসেম্বর কার্যাদেশ পাওয়া প্রতিষ্ঠানটি তাদের কাজ শুরু করে। তবে কাজ শুরু করার প্রায় ৯ মাস পর অর্থাৎ ২০১৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠানটি ওই হাসপাতালের সম্প্রসারণের নির্মাণ কাজ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেয়। এই সময়ে তারা তাদের চুক্তি অনুযায়ী কাজের আংশিক সম্পন্ন করেছিল।
প্রকৌশল নিউজের অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, এই হাসপাতালটির সম্প্রসারণের নির্মাণ কাজ চলাকালে ২০১৯ সালের ১৮ মার্চ প্রথম চলতি বিল ৯ কোটি ৯৫ লক্ষ টাকা এবং তার কয়েক মাস পর ৩০ জুন দ্বিতীয় চলতি বিলে আরও ২০ কোটি টাকা ওই ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটিকে দেওয়া হয়। অর্থাৎ, দুই বিল মিলে ওই ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ২৯ কোটি ৯৫ লক্ষ টাকা উত্তোলন করে। যদিও সে সময় প্রতিষ্ঠানটি এই সমপরিমাণ অর্থের কাজ সম্পন্ন করেনি।
সংশ্লিষ্ঠ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি তাদের কাজ বন্ধ করার পর তাদের চুক্তির শর্ত অনুসরণ করে তাগাদা প্রদান করার পরেও কাজ শুরু করে নাই। এক্ষেত্রে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানটি চুক্তির মৌলিক শর্ত ভঙ্গ করে। এ কারণে ২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানটির সাথে চুক্তি বাতিল করে গণপূর্ত অধিদপ্তর।
পরবর্তিতে, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় হাসপাতালটির নির্মাণ কাজের যৌথ পরিমাপের জন্য একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেয়। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নাজমুল হোসাইন ২০ সালের ২২ মার্চে প্রকল্প পরিচালক, ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি, অধিদপ্তরের বিভাগীয় প্রকৌশলী ও উপ-সহকারী প্রকৌশলীর উপস্থিতিতে এই নির্মাণ কাজের যৌথ পরিমাপ গ্রহন করেন। সেই যৌথ পরিমাপে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটির করা কাজের মূল্যায়ন দাঁড়ায় ১৯ কোটি ৫০ লক্ষ ৯ হাজার ৯৪৫ টাকা।
তাদের এই যৌথ পরিমাপ ও পরিশোধকৃত বিল তুলনামূলক পর্যালোচনা করে দেখা যায়, হাসপাতালের সম্প্রসারণের কাজে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটিকে তাদের করা কাজের অধিক প্রায় ১০ কোটি ৪৫ লক্ষ টাকা বিল হিসাবে দেওয়া হয়েছে।
প্রকৌশল নিউজের পক্ষ থেকে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের নিকট অতিরিক্ত বিল দেওয়ার বিষয়ে জানতে গণপূর্ত অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (উন্নয়ন) মোহাম্মদ ফজলুল হকের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয় (যিনি তৎকালীন শেরে বাংলা নগর গণপূর্ত বিভাগ-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী হিসাবে দায়িত্বে ছিলেন)। প্রতিবারই তার মুঠোফোন নম্বরটি বন্ধ পাওয়া গেছে।
এখানে উল্লেখ্য করা প্রয়োজন, মোহাম্মদ ফজলুল হক ক্যাসিনো কাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ও ঠিকাদার জি কে শামীমকে অনিয়মের মাধ্যমে টেন্ডার পাইয়ে দেওয়ার একজন সম্বস্বয়কারী। এ কারণে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলো দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
গঠন করা হয়েছে কমিটি
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেস ও হাসপাতালের সম্প্রসারণের নির্মাণ কাজে ঠিকাদারকে অতিরিক্ত অর্থ প্রদানের বিষয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ সুপারিশমালা প্রদানের জন্য চলতি বছরের ৩ মে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করেছে গণপূর্ত অধিদপ্তর। কমিটিতে উক্ত অধিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (স্বাস্থ্য) মো. খাইরুল ইসলামকে আহবায়ক করে ঢাকা গণপূর্ত সার্কেল-৪ এর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. উজির আলীকে সদস্য ও ঢাকা গণপূর্ত অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী (সংস্থাপন) আহমেদ আবদুল্লাহ নূরকে সদস্য-সচিব করা হয়েছে।
তথ্য জানাতে অনিহা কমিটির
ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটির অতিরিক্ত অর্থ পাবার বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য জানতে প্রকৌশল নিউজের পক্ষ থেকে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয় কমিটির সদস্য-সচিব আহমেদ আবদুল্লাহ নূরের সাথে। গত দুই দিন ধরে মুঠোফোনে তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। এমনকি এই বিষয়ে জানতে ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও তিনি তার কোন প্রতিউত্তর দেননি।
এই কমিটির আহবায়ক মো. খাইরুল ইসলামের সাথে এই বিষয়ের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানতে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি একটি মিটিংয়ে আছেন বলে এই প্রতিবেদককে এড়িয়ে যান। কখন ফোন দিলে তার সাথে কথা বলা যাবে এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘মিটিং কখন শেষ হবে তা কি করে বলি?’
কমিটির অপর সদস্য মো. উজির আলীর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমরা ডিভিশন থেকে ডাটা চেয়েছি। সর্বশেষ ডাটা গতকাল পেয়েছি। এখন কমিটিতে বসে আমরা রিপোর্টটা করবো। আমরা বিষয়টা দেখছি। রিপোর্টটা সই না করা পর্যন্ত কোন মন্তব্য করা ঠিক হবে না।’
অতিরিক্ত বিল বিষয়ে যা বললেন প্রধান প্রকৌশলী
হাসপাতাল নির্মাণে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে অতিরিক্ত বিল দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আখতার প্রকৌশলনিউজকে বলেন, ‘বিষয়টা হচ্ছে সংশ্লিষ্ট নির্বাহী প্রকৌশলী এই বিলটা দিয়েছিলেন। কিন্তু এই ঠিকাদারের বিভিন্ন ধরণের টাকা আমাদের কাছে জমা আছে। ওই প্রজেক্টেরই রিটেনশন মানি জমা আছে। এছাড়া অনেকগুলো প্রজেক্টের টাকা জমা আছে। সেই রিটেনশন মানি থেকেই সরকারি পাওনাটা আমরা এডজাস্ট করার বিষয়ে ভাবছি। এটা আশা করছি খুব শিঘ্র্রই জমা হয়ে যাবে।’
এই ঘটনায় যে কর্মকর্তা জড়িত থাকার বিষয়ে জানা গেছে তার বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেওয়া হবে এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘যে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, যিনি এটার জন্য দায়ি, আমরা অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। এটার জন্য যে প্রসিডিউর আছে আমরা সে অনুযায়ী কাজ করছি। এটা কিন্তু হুট করে করা যাবে না। আমরা আমাদের তদন্ত করছি। এই বিষয়ে ব্যবস্থা মন্ত্রণালয় থেকে নেওয়া হবে।’