ফুলতলাবাসী ফুঁসে উঠেছে, পানি রক্ষায় ডিসির কাছে স্মারকলিপি


ফুলতলা (খুলনা) প্রতিনিধি
ফুলতলাবাসী ফুঁসে উঠেছে, পানি রক্ষায় ডিসির কাছে স্মারকলিপি
  • Font increase
  • Font Decrease

শহরের মানুষকে নিরাপদ ও সুপেয় পানি সরবরাহের জন্য খুলনা ওয়াসার উদ্যোগের কারণে বিক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে ফুলতলা উপজেলাবাসী। কারণ এই মিঠা পানির ওপর নির্ভর করেই ফুলতলায় গড়ে উঠেছে দেশের নার্সারী, মিঠা পানির চিৎড়ী ঘের এবং চারা ( পোনা বা ছোট ) মাছের ব্যবসা। বহু প্রাচীনকাল থেকে এখানকার ধান এবং অন্যান্য আবাদও মুলত এই পানির ওপরই নির্ভরশীল। তাই পানি রক্ষার জন্য ধারাবাহিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে জেলা প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে ফুলতলার সর্বস্তরের জনপ্রতিনিধি এবং সাধারণ মানুষ। 

এক কথায় বলতে গেলে ফুলতলা থেকে প্রতিদিনি ১ কোটি গ্যালন পানি শহরে নেওয়ার তোড়জোড়ের ব্যাপারে ক্ষোভে-বিক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে উপজেলার সাধারণ মানুষ। পানি নেওয়ার উদ্যোগ এখনই বন্ধ না করলে বড় ধরনের আন্দোলনে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে পানি ও পরিবেশ রক্ষা কমিটি। 

এদিকে জেলা প্রশাসকের কাছে দেওয়া স্মারকলিপির প্রেক্ষিতে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে পাঁচ সদস্যের রিভিউ কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন। সেখানে ফুলতলা উপজেলার একজন প্রতিনিধি, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় এবং খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন করে প্রতিনিধি এবং খুলনা জেলা ও খুলনা সিটি কর্পোরেশনের একজন প্রতিনিধি রাখা হয়েছে। স্বল্প সময়ের মধ্যে টেকনিক্যাল বিষয় পর্যালোচনা করে তারা জেলা প্রশাসনের কাছে রিপোর্ট জমা দেবে। 

এ বিষয়ে প্রকৌশল নিউজকে উপজেলা চেয়ারম্যান শেখ আকরাম হোসেন বলেন, বিষয়টি আমরা জেনেছি। প্রশাসনের তড়িৎ এই উদ্যোগে আমরা খুশি। কিন্তু আমাদের দাবি একটাই, ফুলতলা থেকে পানি শহরে নিতে দেওয়া হবে না। কারণ যে সমস্ত অযুহাতে ফুলতলা থেকে ভু-গর্ভস্থ পাইপ লাইনের মাধ্যমে খুলনা শহরে পানি নেওয়ার পরিকল্পনা হচ্ছে সেটা একেবারেই খোড়া যুক্তি। উপজেলার সর্বস্তরের মানুষ এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। জনপ্রতিনিধি হিসেবে আমি তাদের বিপক্ষে গিয়ে কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নের পক্ষে যেতে পারি না। আসন্ন ঈদের পর সব রাজনৈতিক দল এবং সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করে বড় ধরনের আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত আছে উপজেলাবাসী। আমরা আশা করি খুলনা ওয়াসা তাদের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবে।’  

কমিটির যুগ্ম আহ্ববায়ক ও ফুলতলা প্রেসক্লাবের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান প্রকৌশল নিউজকে জানিয়েছেন, উপজেলা এবং জেলা প্রশাসন তাদের আশ্বস্ত করেছে যে দ্রুত সময়ের মধ্যে তারা আইনগত বিষয় খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেবেন। যদি প্রশাসন ফুলতলার পানি রক্ষার কোনো উদ্যোগ না নেয় তাহলে কিভাবে আন্দোলন এগিয়ে নেবেন এমন প্রশ্নের জবাবে তার সাফ উত্তর ‘পানি ও পরিবেশ রক্ষার জন্য সকল রাজনৈতিক দল এবং সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করে বৃহত্তর আন্দোলনের ডাক দেওয়া হবে। প্রয়োজনে রক্ত দেবো তবুও ফুলতলার পানি আমরা নিতে দেব না।’ 

স্থানীয় বিভিন্ন শ্রেনী পেশার মানুষের সাথে কথা বলেও জানা যায়, তারা এই আন্দোলনের সাথে একাট্টা। পানি বাঁচাতে তারা যে কোনো আন্দোলনে অংশ নিতে মুখিয়ে আছেন। 

বিশেষ করে ফুলতলার তরুণ প্রজন্ম খুলনা ওয়াসার এই পানি নিয়ে যাওয়ার পায়তারাকে খুবই নেতিবাচকভাবে গ্রহণ করেছে। ইতিমধ্যে উপজেলার চার ইউনিয়নের প্রতিটি ওয়ার্ডে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। যে কোনো সময় বড় ধরনের প্রতিরোধের ডাক আসলেই তারা পানি বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রস্তুত। 

এলাকার স্থানীয় মানুষদের সাথে কথা বলে জানা যায়, খুলনা শহরে বসবাসকারী জনগণের পানির প্রয়োজন মেটাতে ওয়াসার এ সিদ্ধান্ত সাধারণ দৃষ্টিতে সময়োপযোগী মনে হতে পারে কিন্তু ফুলতলাবাসী এই পানি নেওয়ার বিরোধিতা করার যৌক্তিক কারণও রয়েছে।

ফুলতলা থেকে ওয়াসার ভূগর্ভস্থ পানি নেওয়ার প্রতিবাদে উপজেলার সুধীসমাজ বিভিন্ন সময়ে জেলা প্রশাসক এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বরাবর দাবি জানিয়ে আসছে যে, ফুলতলা থেকে ভূগর্ভস্থ পানি নেওয়া যাবে না। ২০০৩ সালে নেওয়া সরকারের প্রকল্প সে সময় থেমে যায় ফুলতলাবাসীর আন্দোলনের কারণে। প্রায় ১৮ বছর পর কেন খুলনা ওয়াসা আবারো সেই বিতর্কিত প্রকল্প সচল করতে চাইছে। এর পেছনে তাদের যুক্তি কি? 

খুলনা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ প্রকৌশল নিউজকে জানান, ২০০৩ সালে নেওয়া প্রকল্প সে সময় ফুলতলাবাসীর আন্দোলন এবং এনজিও ‘বেলা’র পক্ষ থেকে করা রিটের কারণে স্থগিত হয়ে যায়। কিন্তু দেশের সর্বোচ্চ আদালত ২০১৬ সালে সেই ‘স্টে’ রায়ের বিপরীতে খুলনা সিটি কর্পোরেশনের অনুকূলে রায় প্রদান করে। ইতিমধ্যে ২০০৮ সালে খুলনা ওয়াসা প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকে কর্পোরেশন এলাকায় পানি সরবরাহের দায়িত্ব পালন করছে। সে কারণে খুলনা ওয়াসা সিটি কর্পোরেশনের নির্দেশক্রমে বিষয়টি নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করছে। ঐ এলাকায় স্থাপিত সে সময়ের ২০টি গভীর নলকূপের ৭টিতে প্রাথমিক পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানোর জন্য বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়েছে। আমরা দেশীয় পানি ব্যবস্থাপনা আইনের মধ্যে থেকেই কাজ করার চেস্টা করছি। যেহেতু সরকারের বিনিয়োগ রয়েছে এবং আইনগত কোনো বাঁধা নেই। সুতরাং আমরা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে পরে সিদ্ধান্ত নেবো। 

আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ওয়াসা বা সিটি কর্পোরেশন মানবিক বিষয় বিবেচনা করবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে খুলনা ওয়াসার এমডি বলেন, আমরা সরকারি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য পরিক্ষী নিরীক্ষা চালাচ্ছি। এর বাইরে আপাতত কিছু বলা সম্ভব না। 

তবে কি পরিমান পানি উত্তোলন করা হবে সে বিষয়ে এখনো কোনো চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি খুলনা ওয়াসা। আর আইনে আছে, ভূ-গর্ভস্থ পানির মালিক সরকার। 

চলুন দেখে নেওয়া যাক কি আছে পানি ব্যবস্থাপনা আইনে। কৃষিকাজে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবস্থাপনা আইন ২০১৮ ও ১৯৮৩ সালের আন্তর্জাতিক আইন এবং বাংলাদেশ পানি আইন ২০১৩ এর পঞ্চম অধ্যায়ে উল্লেখ করা হয়েছে, আপাততঃ বলবৎ অন্য কোন আইনে ভিন্নতর যাহা কিছুই থাকুক না কেন, নির্বাহী কমিটি, যথাযথ অনুসন্ধান, পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা জরিপের ফলাফলের ভিত্তিতে, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, যে কোন এলাকার ভূগর্ভস্থ পানিধারক স্তরের সর্বনিম্ন নিরাপদ আহরণ সীমা (safe yield) নির্ধারণ করিতে পারিবে। এ আইনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, কোন ব্যক্তি বা উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ, ভূগর্ভস্থ পানিধারক স্তরের সর্বনিম্ন নিরাপদ আহরণ সীমা ও বিদ্যমান অন্যান্য আইনের বিধানাবলি সাপেক্ষে, ভূগর্ভস্থ পানি আহরণের জন্য বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে, গভীর বা অগভীর নলকূপ স্থাপন করিতে পারিবে। 

‘নিরাপদ আহরণ সীমা’ অর্থ পানিধারক স্তর হইতে পানির এমন কোন পরিমাণ উত্তোলন যাহার ফলে পানিধারক স্তর নিরাপদ ও সুরক্ষিত থাকে। 

সরকারের সর্বশেষ তথ্যমতে দেশে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ৩ থেকে ১০ মিটার পর্যন্ত নেমে গেছে। সুপেয় পানি ও কৃষিকাজে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর অধিক হারে নির্ভরশীলতার কারণে এ স্তর নেমে যাচ্ছে। যা পরিবেশের জন্য অশনি সংকেত। এছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৪৪ শতাংশ মানুষ খাওয়ার জন্যে নিরাপদ পানি পায় না। ফলে এটি সহজেই অনুমেয় যে আইনে উল্লেখিত" নিরাপদ আহরণ সীমা" বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 

এ বিষয়ে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, আমরা আপাতত পরীক্ষা নিরীক্ষা করছি। 

এসব বিষয় নিয়ে ফুলতলাবাসীর বক্তব্য, খুলনা শহরে পানিসংকট নিরসনের বিষয়ে তাদের কোন দ্বিমত নেই। তবে তারা চান আইনের লঙ্ঘন এবং একটি এলাকার পরিবেশ বিপর্যয় ঘটিয়ে এমন কাজ যেন না করা হয়। খুলনা ওয়াসাকে তারা পরামর্শ দিয়েছেন যে, মধুমতি নদী এবং রুপসা নদীর পানি শোধনপূর্বক নগরবাসীকে সরবরাহ করা হোক। সেক্ষেত্রে রক্ষা পাবে ফুলতলা উপজেলার পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য।

***  রক্ত দিলেও পানি দেবে না ফুলতলাবাসী