নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন সুবিধা পাচ্ছে হাওরবাসী


ডেস্ক নিউজ
নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন সুবিধা পাচ্ছে হাওরবাসী
  • Font increase
  • Font Decrease

সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার পশ্চিম জাফলং ইউনিয়নের ‘পান্থুমাই’ গ্রাম বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর গ্রামগুলোর মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত মেঘালয় পাহাড়ের কোল ঘেঁষা মেঘালয় পাহাড় আর পিয়াইন নদীর পাড়ে অবস্থিত এই গ্রামেই আছে প্রকৃতির আরেক অপরূপ নিদর্শন পান্থুমাই ঝর্ণা। কেউ একে ‘ফাটাছড়ির ঝর্ণা’ বলে ডাকে আবার কেউবা ডাকেন ‘বড়হিল ঝর্ণা’, আর কারো চোখে এটি ‘মায়াবতী’! এখানকার টুরিষ্ট পয়েন্টে কাজ করেন সালেহ আহমেদ। তিনি বলেন, ‘পূর্বে আমাদের এই পর্যটন কেন্দ্রে কোন টয়লেট ছিল না, পর্যটক এখানে গ্রামের বাড়িতে অথবা খোলা জায়গায় গিয়ে তারা তাদের জরুরী প্রস্রাব-পায়খানার কাজকরত। এখন একটি দৃষ্টিনন্দন ইম্প্রুভ ল্যাট্রিন পাওয়ায় পর্যটকরা অনেক উপকৃত হইছে। গোয়াইনঘাট ফ্লাশ ফ্লাভ প্রবণ এলাকা বিধায় টয়লেটটি উঁচু স্থানে করা হয়েছে, এতে আমরা অনেক উপকৃত হয়েছি। পানি সরবরাহসহ টয়লেট নির্মিত হয়ায় পর্যটন কেন্দ্র উন্নত হবে বলে এলাকাবাসী আশাবাদী।’

সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলার লেঙ্গুড়া ইউনিয়নের হবি আহমেদ। পেশায় কৃষক হবি আহমেদ তিন সন্তানের জনক। ‘অল্প’ আয়ে চলা হবি আহমেদ নিরাপদ পানি নিয়ে তার সংগ্রামের কথা জানালেন। তিনি যা বললেন তার সারমর্ম হলো, হাওরের মাঝে আমার বাড়ী, এখানে আগে অনেক দূর থেকে পানি বহন করে নিয়ে আসতে হতো যা মহিলাদের জন্য অনেক কষ্টকর। অনেক সময় হাওরের পানি ফিল্টার করে খেতে হতো তাতে অনেক অসুখ বিশুখে আক্রান্ত হতাম। এখন একটি গভীর নলকূপ পাওয়ায় আমার আশেপাশের কয়েকটা পরিবারসহ অনেকে উপকৃত হয়েছে। এতে বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থা হয়েছে।

হবি আহমেদ যে এলাকায় বাস করেন সেখানকার সাথে ছিলেট শহরের সরাসরি কোন সড়ক যোগাযোগ নেই। বর্ষাকালে জেলা শহরে নৌকাই একমাত্র যোগাযোগের বাহন। আর শুকনো মৌসুমে কয়েক কিলোমিটার পায়ে হেটে গিয়ে সড়কে উঠতে হয়। গ্রামের কোন মানুষের রোগ-বালাই হলে উপজেলা হাসপাতালে নিয়ে যেতেও অনেক কষ্ট পেতে হয়। এমন এলাকায় নিরাপদ পানির সংস্থান হওয়ায় তিনি খুবই খুশি।

ওই ইউনিয়ানের নিয়াগুল গ্রামের খায়রুল ইসলাম বলেন, ‘এখন গভীর নলকূপ পাওয়ায় আমাদের আশেপাশের কয়েকটা পরিবারসহ অনেকে উপকৃত হয়েছে। এতে বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থা হয়েছে ও মহিলাদের সময় ও কষ্ট দূর হয়েছে।’

শুধু গোয়াইনঘাটের লেঙ্গুড়া ইউনিয়নের লেঙ্গুড়া গ্রাম বা নিয়াগুল গ্রামই নয়। ছিলেট এলাকার পর্যটন এলাকা পান্থুমাই ও বিছারকান্দি এলাকাসহ হাওড় অঞ্চলের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠিকে নিরাপদ সুপেয় পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন সুবিধা ও জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে ‘হাওর অঞ্চলে টেকসই পানি সরবরাহ, স্যানিটেশন ও হাইজিন ব্যবস্থার উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট প্রকল্প’টি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। প্রকল্পটি হাওরভিত্তিক ৭টি জেলা সুনামগঞ্জ, সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও নেত্রকোনার আওতাধীন ৫৪ টি উপজেলার ৩৪০টি ইউনিয়নে কাজ চলমান আছে।

জানাগেছে, আকস্মিক বন্যা ও বিভিন্ন প্রাকৃতিক দূর্যোগের কারণে হাওর অঞ্চলে নিরাপদ পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন সুবিধা দেওয়া বড় ‘চ্যালেঞ্জ’।  ইতিমধ্যে প্রকল্পের আওতায় স্থানীয় হাইড্রোজিওলজিক্যাল পরিস্থিতি, পানির উৎস, উৎসের গুনাগুন এবং স্থানীয় জনগনের চাহিদার উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ধরণের পানির উৎস স্থাপন করা হয়েছে। পানি সরবরাহের ক্ষেত্রে ‘অবহেলিত ও সুবিধাবঞ্চিত’ এলাকাগুলোকে পানির উৎস স্থাপনের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় সংসদ সদস্য ৫০ শতাংশ ও ইউনিয়ন ওয়াটসন কমিটি ৫০ শতাংশ স্থান  নির্বাচন করেছেন তা স্থানীয় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রকৌশলী ও কর্মকর্তাগণের পরামর্শক্রমে চুড়ান্ত করেছেন। এই প্রকল্পে ইউনিয়নে বরাদ্দকৃত পনির উৎস বন্ঠনের ক্ষেত্রে  সংশ্লিষ্ট জেলার নির্বাহী প্রকৌশলীরা জনসংখ্যার ঘনত্বের উপর ভিত্তি করে বন্টন করেন। তবে, এক্ষেত্রে তারা অন্যান্য গ্রামীন পানি সরবরাহ প্রকল্পের অভিজ্ঞতাও কাজে লাগানো হয়েছে।  স্থাপনা নির্মাণের ক্ষেত্রে ইউনিয়ন পরিষদ বা উপকারভোগী জনগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে দেওয়া জমিতে ‘সাইট সিলেকশন’ করে কাজ শুরু করা হয়েছে।

হাওর অঞ্চলে টেকসই পানি সরবরাহ, স্যানিটেশন ও হাইজিন ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রকল্পের  পরিচালক (পিডি) মো. সোহরাব উদ্দিন আহমেদ বলেন,  ‘চলতি অর্থ বছরে এডিপির প্রায় ৮৬ শতাংশ ভৌত ও ৮২ শতাংশ আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে।  সার্বিকভাবে প্রকল্পের ক্রমপুঞ্জিভুত ভৌত অগ্রগতি ৬৬ দশমিক ৬৬শতাংশ এবং আর্থিক ৬২ দশমিক ৬৬ শতাংশ।’

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল সূত্রে জানা গেছে,  হাওড় ও জলাশয় উন্নয়ন বোর্ড এর মাস্টার প্লান (ভলিউম-২) অনুযায়ী,  হাওর অঞ্চলের  ৫০ শতাংশ পরিবার গৃহস্থালী কাজের (পারিবারিক ব্যবহারের) জন্য পার্শ্ববর্তী নদী বা পুকুরের পানির উপর নির্ভরশীল। প্রায় ১০ শতাংশ মানুষের নিরাপদ পানি স¤পর্কে কোন ধারণা নেই। সেখানকার  প্রায় ৮০ শতাংশ পরিবারের লোকজন ডায়রিয়াজনিত রোগে কোন না কোন সময় ভুগেছিলেন। এছাড়া এখানকার মানুষ বিভিন্ন সময় আমাশয়, কলেরা এবং টাইফয়েড ও পানিবাহিত সাধারণ রোগ দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। 

সোহরাব উদ্দিন আহমেদ আরো বলেন, ‘হাওরবাসীদের দীর্ঘ দিনের নিরাপদ পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। এর ফলে ৭ জেলার ৫০ শতাংশ মানুষের নিরাপদ পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন সুবিধার আওতায় আসবে। তবে এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে সচেতনতা, প্রশিক্ষণ, স্থাপনকৃত নলকূপ এবং ল্যান্ট্রিন পরিচালনা এবং রক্ষণাবেক্ষবেক্ষণের জন্যও আলাদা গ্রুপ করার মাধ্যমে স্থানীয় জনগোষ্ঠিকে সেবা নিশ্চিত করার কাজ চলছে।’

প্রকল্পে মুল কাজের মধ্যে রয়েছে, তারা  গভীর নলকূপ/ মডিফাইয়েড তারা/ সাবমার্সিবল পাম্পযুক্ত নলকুপ স্থাপন, গভীর নলকূপ স্থাপন,  ইম্প্রুভ্ড ল্যাট্রিন স্থাপন, অফসেট টুইন পিট ল্যাট্রিন স্থাপন ও এনজিও-এর মাধ্যমে হাইজিন প্রমোশন।

প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘সামাজিক প্রচারনার মাধ্যমে হাওর অঞ্চলে নিরাপদ পানি ও স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন বিষয়ে স্থানীয় জনগনের সচেতন করা, গভীর নলকূপ মডিফাইড সাবমার্সিবল পাম্পযুক্ত নলকূপ স্থাপন ও ব্যবহার সম্পর্কে প্রয়োজনীয় সহায়তা, পরামর্শ দেয়া হবে। ইতোমধ্যে আমাদের ১৯ হাজার ২২৭ টি নলকুপ স্থাপন করা হয়েছে। হাইজিন প্রমোশনের জন্য প্রচারণার পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গায় ২হাজার ৩৩৩ টি ইম্প্রুভ টয়লেট স্থাপন করা হয়েছে।’

২০২০ সালের ২১ জুন একনেক সভায় প্রকল্পটি অনুমোদন পাওয়ার পর পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছিলেন, ‘এ প্রকল্পটির মাধ্যমে হাওর অঞ্চলে ২২ হাজার ৬৪২টি মোডিফাইড, সাব মার্সিবল নলকূপ স্থাপন করা হবে। এছাড়া ৫ হাজার ৬৬১টি গভীর নলকূপ স্থাপন, ৪ হাজার ১২৬টি উন্নত ল্যাট্রিন স্থাপন করা হবে এবং ৪৫৮টি অফসেট টুইন পিট ল্যাট্রিন স্থাপন করা হবে।’