শিশু নিনাদ হত্যা : অবশেষে চার্জশিটে মূল সন্দেহভাজনের নাম
রাজধানীর খিলগাঁওয়ের মেরাদিয়ার ভূঁইয়াপাড়ার স্বপন বেপারির আট বছরের শিশু সন্তান সাফওয়ান আল নিনাদকে হত্যা করা হয়েছিল তিন বছর আগে। সম্প্রতি আরও এক আসামির নাম যুক্ত করে চূড়ান্ত চার্জশিট দিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। যেখানে দ্বিতীয় সন্দেহভাজন হিসেবে যুক্ত করা হয়েছে শিশুটির মায়ের মামী খাদিজা আক্তার রানীকে।
থানা পুলিশ, ডিবি, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) চার্জশিটে এ নামটি না এলেও সিআইডির মূল তদন্তে তার নামটি উঠে আসে। নিনাদ হত্যার তদন্ত যখন ডিবি পুলিশ করছিলেন তখন থেকেই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে এ হত্যার মূল হোতা হিসাবে খাদিজা আক্তার রানীর নাম বলে আসছিলেন নিনাদের পরিবার। ডিবি পুলিশ একবার ৫৪ ধারায় খাদিজাকে গ্রেফতার করেছিল। কিন্তু তাদের চার্জশিটে খাদিজার নাম আসেনি। কিন্তু সর্বশেষ সিআইডির তদন্তে বারবার খাদিজার নাম এসেছে এবং তাকে চার্জশিটে ২নং আসামি করা হয়েছে।
সিআইডির পরিদর্শক ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মাইনুল ইসলাম বলেন, এ মামলায় আরও একজনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে এবং সেটা আদালতে পাঠানো হয়েছে। তিনি বলেন, খুনের পারিপার্শ্বিক সব বিষয়ের সঙ্গে খাদিজার সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। নিনাদকে হত্যার আগে তাদের বাসায় চকোলেট খাওয়ানোর কথা বলে নিয়ে যাওয়া হয়।
বীথি নামে এক প্রত্যক্ষদর্শী অভিযুক্ত খাদিজার হাতে নিনাদকে দেখেছে বলে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। ৮ জুন সিআইডি চূড়ান্ত চার্জশিট দিয়েছে আদালতে। এর আগে থানা, গোয়েন্দা পুলিশ ও পিবিআই মামলাটির তদন্ত করেছিল। পরপর দু’বার একজনকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছিল আদালতে। তবে বাদীর নারাজিতে চতুর্থ তদন্ত সংস্থা হিসাবে দায়িত্ব পায় সিআইডি। দায়িত্ব পাওয়ার দুই মাসের মধ্যে হত্যায় জড়িত সন্দেহে খাদিজাকে গ্রেফতার করে তারা। খাদিজা হলেন নিনাদের মায়ের মামি এবং ডিবি ও পিবিআইর অভিযোগপত্রের আসামি জহিরুল ইসলাম ওরফে লুড্ডুর স্ত্রী। বর্তমানে তারা দু’জনে জামিনে রয়েছেন।
সিআইডির চার্জশিটে বলা হয়, তদন্তে প্রাপ্ত সাক্ষ্য প্রমাণ, সাক্ষীর জবানবন্দি, সুরতহাল প্রতিবেদন ও অন্যান্য আলামত পর্যালোচনায় জহিরুল ইসলাম ওরফে লুড্ডু ও তার স্ত্রী খাদিজা আক্তার রানীর অপরাধ প্রমাণ পাওয়া গেছে। নানা রকম জোরালো আলামতের ভিত্তিতেই লুড্ডুকে এক নম্বর ও তার স্ত্রী খাদিজা আক্তার রানীকে দুই নম্বর আসামি করা হয়েছে।
খিলগাঁওয়ের বনশ্রী ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুলের প্রথম শ্রেণির ছাত্র ছিল সাফওয়ান আল নিনাদ। ২০১৮ সালের ১৫ জুন ঈদের চাঁদ রাতে বাসা থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হয় সে। পরদিন ঈদের দুপুরে বাড়ির পাশে বেকারির পণ্যবাহী ভ্যানগাড়ির ভেতর নিনাদের লাশ দেখতে পায় অন্য শিশুরা। ওই দিনই অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে খিলগাঁও থানায় হত্যা মামলা করেন নিনাদের বাবা স্বপন বেপারি। প্রথমে থানা পুলিশ এ মামলা তদন্ত করলেও হত্যাকাণ্ডের কোনো ক্লু বের করতে পারেনি। পরে মামলার তদন্তভার দেওয়া হয় ডিবিকে। ডিবির তদন্তের পর ২০১৯ সালের ১১ মার্চ আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা।
ওই অভিযোগপত্র থেকে জানা গেছে, গলায় পেঁচানো পলিথিনের সূত্র ধরে শুরু হয় রহস্য উদঘাটন। ঘটনার রাতে পাশের দোকান থেকে একই রকম পলিথিন নেন নিনাদের মায়ের মামা লুড্ডু। লুড্ডু ও তার বড় বোন ছালেহা বেগমের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে পৈতৃক সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ চলছিল। এ ঘটনার জের ধরে শিশু নিনাদকে লুড্ডু হত্যা করেছে বলে প্রাথমিকভাবে সত্যতা মেলায় তাকে ওই সময় গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ। কিন্তু মূল সন্দেহভাজনকে বাদ রেখে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে বলে এ অভিযোগ তুলে আদালতে নারাজি দেন বাদী।
আদালত পরে মামলাটি পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেন। পিবিআইও লুড্ডুকে আসামি করে ফের অভিযোগপত্র দেয়। আবারও নারাজি দেন বাদী। তৃতীয়বারের মতো মামলার তদন্ত দায়িত্ব সিআইডিকে দেন আদালত। সিআইডি দুই মাস ধরে মামলাটি তদন্ত করে চূড়ান্ত চার্জশিট দেয়।
এ মামলার চূড়ান্ত অভিযোগপত্র, নিনাদের বাবা বাদী স্বপন বেপারি ও আরও কয়েকটি সূত্রে চাঞ্চল্যকর এ হত্যার জট অনেকটাই বেরিয়ে এসেছে। সেখান থেকে জানা যায়, তিন বছরেও নিনাদ হত্যার কূল-কিনারা হয়নি। সম্প্রতি এক কিশোরীর জবানবন্দিতে নিনাদ হত্যারহস্যের জট খুলেছে। এ মামলার অন্যতম হোতা খাদিজা। খাদিজার বাসায় ভাড়াটিয়া হিসাবে বসবাস করে আসছে কিশোরী বীথি আক্তার ও তার পরিবার। ঈদের আগের রাতে সে খাদিজার ঘরে বেড়াতে গিয়েছিল। ওই সময় নিনাদকে নিয়ে ঘরে ঢোকেন খাদিজা। আতশবাজি ও চকলেট দেওয়ার কথা বলে খাদিজা কৌশলে নিনাদকে তার বাসায় ডেকে আনেন। বীথি তা দেখেছে। বীথি এরই মধ্যে ঘটনার বিবরণ দিয়ে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে। বীথি তার জবানবন্দিতে বলে, ঈদের আগের রাতে রানী কাকির ঘরে গিয়েছিলাম। তার মেয়ে জান্নাতের সঙ্গে বসাছিলাম। এ সময় নিনাদকে নিয়ে কাকিকে ঘরে আসতে দেখছি। কিছুক্ষণ পর ১০০ টাকা দিয়ে আমাকে ও জান্নাতকে বেলুন কিনতে বাইরে পাঠান। বেলুন কিনে বাসায় ফেরার পর নিনাদ কোথায় জানতে চাইলে কাকি বলেন, তার বাসায় ফিরে গেছে। এরপর আঙ্কেলকে (খাদিজার স্বামী) কোল বালিশের মতো কিছু একটা নিয়ে নামতে দেখি। এগুলো কী জান্নাত, এটা জানতে চাইলে কাকি জবাব দেন পুরোনো কাপড়। পরদিনই শুনি নিনাদের লাশ পাওয়া গেছে।’
কিশোরী বীথি জবানবন্দিতে এও বলেছে বলে জানা যায়, নিনাদকে খাদিজার সঙ্গে দেখার পর সে প্রশ্ন করে, পরিবারের সঙ্গে ঝগড়া থাকলেও কেন নিনাদকে বাসায় এনেছে? জবাবে খাদিজা জানান, চকলেটসহ ওকে নানা কিছু কিনে দেওয়া হবে। এর পরই বীথি ও জান্নাতকে বাইরে পাঠিয়ে নিনাদকে নিয়ে ছাদে যান খাদিজা ও তার স্বামী জহিরুল ইসলাম লুড্ডু।
এখন পর্যন্ত চারজন এ মামলায় সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দিয়েছেন। তাদের মধ্যে বীথি ছাড়াও দোকানি সাদেক রয়েছেন। তার দোকান থেকে লুড্ডু একটি লম্বা পলিথিন চেয়ে নিয়েছিলেন। নিনাদের গলায় একই ধরনের লম্বা পলিথিন পেঁচানো ছিল। সেই লম্বা পলিথিন শনাক্ত করেছেন সাদেক। তার দেওয়া প্রাথমিক তথ্যে এ মামলার প্রথম সন্দেহভাজন হিসাবে জহিরুল ইসলাম ওরফে লুড্ডু গ্রেফতার করে থানা পুলিশ। তিনি এখন জামিনে রয়েছেন। ঘটনার দিন বীথি যা দেখেছিল তা আরেক ভাড়াটিয়া মাকসুদা বেগমকে বলেছিল। তিনিও সাক্ষী হিসাবে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। দোকানি সাদেকের কাছ থেকে পলিথিন চেয়ে নিতে দেখেছিলেন আশরাফুল নামে একজন। তিনিও জবানবন্দি দিয়েছেন। নিনাদের বাবা মামলার বাদী স্বপন বেপারি বলেন, চার্জশিটে খাদিজার নাম আসায় আমরা খুশি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস লুড্ডু-খাদিজার মেয়ে রুমানা ইসলামকে গ্রেফতার ও জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে হত্যার রহস্য আরও পরিষ্কার হয়ে আসবে।
প্রকৌশল নিউজ/এমআরএস