ফুটপাত অবৈধ দখলমুক্ত ও আধুনিক ঢাকা গড়ার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর
ঢাকা মহানগরীকে সীমিত শক্তি দিয়েই যতদূর সম্ভব বসবাসের উপযোগী করায় জন্য তাঁর সরকারের প্রচেষ্টার উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফুটপাতগুলো দখলমুক্ত রাখতে এবং পথচারীদের চলাচলের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন।
তিনি গুলশাল, বনানি, বারিধারার মত এলাকার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আরো উন্নয়নের জন্যও সংশ্লিষ্ট মেয়রকে নির্দেশ প্রদান করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের যারা ইঞ্জিনিয়ার বা আর্কিটেক্ট, যখন তারা কোন প্ল্যান করবেন অন্তত ফুটপাতটা যেন মানুষের হাঁটার যোগ্য থাকে এবং সেটা যেন দখল না হয় যেদিকে দৃষ্টি দিয়েই করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘আর কাউকে দোষ দেব না আমাদের প্ল্যান করা সময়ই এই সর্বনাশটা করা হয়ে যায়।’ যেটাকে তিনি ‘দুর্ভাগ্যজনক’ বলেও উল্লেখ করেন।
প্রধানমন্ত্রী আজ দুপুরে ‘ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে (ডিএনসিসি) নতুনভাবে অন্তর্ভুক্ত ১৮টি ওয়ার্ডের সড়ক অবকাঠামো ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার নির্মাণ ও উন্নয়ন (ফেজ-১)’ শীর্ষক প্রকল্পের কাজের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন।
তিনি গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ডিএনসিসি’র ৪৪ নং ওয়ার্ডস্থ কাঁচকুড়া হাইস্কুল প্রাঙ্গনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন।
ঘন বাসতিপূর্ণ হরিরামপুর এক সময় অত্যন্ত অবহেলিত ছিল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়িত হলে এই অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকার মান আরও উন্নত হবে এবং মানুষের স্বাস্থ্যকর ভাবে বসবাস করতে পারবেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ঢাকা শহরটাকে সীমিত শক্তি দিয়েই যতদূর সম্ভব আধুনিকায়ন করা, সবুজায়ন ও বসবাসের উপযোগী করার আমরা চেষ্টা করছি। নতুন ইউনিয়নগুলো যুক্ত করার মাধ্যমে ১৮টি ওয়ার্ড করেছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখানে খেলার মাঠ, পাবলিক টয়লেটসহ নানা নাগরিক সুবিধা সৃষ্টির জন্য যে প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে এই নতুন ঢাকা আরো সুন্দর হয়ে উঠবে বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। কেননা এই কাজের দায়িত্ব প্রাপ্ত ২৪ ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাটালিয়ানও তাঁর হাতেই সৃষ্টি এবং যখনই তাঁদেরকে কোন কাজের দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে তাঁরা তা সুষ্ঠু ভাবেই সম্পন্ন করছেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গায় তাঁরা জনগণের পাশে থেকে সেবা করে যাচ্ছেন।
তাঁর সরকারের প্রচেষ্টায় দেশের উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে গ্রাজুয়েশন প্রাপ্তির প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, আজকে একটা সম্মানজনক জায়গায় আমরা আসতে পেরেছি। যেটা ধরে রেখেই আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে। সাথে সাথে আমাদের নাগরিক সুবিধাটাও বাড়াতে হবে।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মো.তাজুল ইসলাম অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। সেনাপ্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ এবং স্থানীয় মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন।
২৪ ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের কমান্ডার বিগ্রেডিয়ার জেনারেল এস এম জাকারিয়া হোসেন প্রকল্পের ওপর পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করেন। স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন।
সাধারণ জনগণকে অধিকতর সেবা প্রদানের জন্য গত ৪ ডিসেম্বও, ২০১১ তারিখে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনকে দুইটি অংশে বিভক্ত করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এবং ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে পরিণত করা হয়।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের আওতায় উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত হরিরামপুর ইউনিয়ন এবং পূর্বাঞ্চলে উত্তরখান, দক্ষিণখান, বাড্ডা, বেরাইদ, ডুমনি, সাঁতারকুল ও ভাটারা ইউনিয়নের এলাকা সমূহের ১৮টি ওয়ার্ডকে নতুনভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
চলমান প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হলেএই ১৮টি ওয়ার্ডে বসবাসরত জনসাধারণের নিরাপদ যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটবে। সেইসাথে বিদ্যমান জলাবদ্ধতা দূরীভূত হবে এবং নাগরিক সেবার মান বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে।
ডিএনসিসি’র নতুন এই ওয়ার্ডগুলোর জন্য ২০২০ সালের ১৪ জুলাই ৪ হাজার ২৫ কোটি ৬২ লাখ টাকার প্রকল্প ‘একনেক’ অনুমোদন করে । তবে, করোনার কারণে কাজ শুরু হতে দেরি হচ্ছিল।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২১ বছর পর সরকার গঠনের সময় তাঁর একটাই লক্ষ্য ছিল এদেশের শোষিত বঞ্চিত মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন পূরণ করা। অর্থাৎ বাংলাদেশের মানুষ বিশ্ব দরবারে বিজয়ী জাতি হিসেবে সম্মানের সাথে মাথা উঁচু করে চলবে।
অগ্নিঝরা মার্চ মাসের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ৭ মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণ, ১৭ মার্চ জাতির পিতার জন্মদিন এবং ২৬ মার্চ আমাদের স্বাধীনতা-সেই স্মৃতি বুকে নিয়েই আজও আমরা বেঁচে আছি, এগিয়ে যাচ্ছি, সেই চেতনা থেকেই আমরা দ্রুত বাংলাদেশকে উন্নয়নের ধারায় নিয়ে আসার প্রেরণা পাচ্ছি।
বাংলাদেশের জনগণের প্রতি তিনি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, তাঁরা বারবার ভোট দিয়ে নির্বাচিত করায় সরকারের ধারাবাহিকতা ছিল বলেই আজকে দেশের উন্নতি করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু, আমরা চাচ্ছি বাংলাদেশকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে তুলতে। যাতে, এর প্রত্যেকটা নাগরিক এখনকার নাগরিক সুবিধাগুলো ভোগ করতে পারে এবং উন্নত জীবন পেতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই ঢাকা শহর এক সময় চারিদিকে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু এবং শীতলক্ষ্যা পরিবেষ্টিত একটি সুন্দর শহর ছিল। যা ’৭৫ পরবর্তী সরকারগুলোর অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং শহরমুখি জনতার চাপ এই শহরকে ধীরে ধীরে বাসবাসসের অনুপযোগী করে ফেলেছে।
তিনি বলেন, যখন সিটি কর্পোরেশন করা হলো একটা মাত্র সিটি কর্পোরেশন কিন্ত জনসংখ্যা এত বিশাল। কাজেই একটা সিটি কর্পোরেশন দিয়ে এত মানুষের সেবা দেয়া সম্ভব নয় ছিল না। পাশাপাশি, সংলগ্ন ইউনিয়নগুলো যেগুলো ন্যূনতম নাগরিক সুবিধা বঞ্চিত ছিল। এ সব ইউনিয়নকে অর্ন্তভূক্ত করে তাদের ওয়ার্ডে পরিণত করে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনকে তিনি দুটি ভাগে ভাগ করার সিদ্ধান্ত নেন বলে উল্লেখ করেন। আর যা বাদ বাকী এলাকা রয়েছে সেগুলো অচিরেই অন্তর্ভূক্ত করা হবে।
এ সময় তিনি উৎপাদন খরচের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে এখানে বসবাসকারীদের বিদ্যুৎ ও পানি ব্যবহারে সাশ্রয়ী হবার পরামর্শ দেন। পাশাপাশি, পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতায় মনোযোগী হবার, ট্রাফিক আইন মেনে চলার এবং বৃক্ষরোপনের মাধ্যমে পরিবেশ সুন্দর রাখার কথাও বলেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদেরকে তাঁর সরকারের উন্নয়ন কাজে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সহযেগিতা করার ও আহ্বান জানান।
বিভিন্ন খাল পূনরুদ্ধারের পদক্ষেপ নেয়ায় তিনি উত্তর সিটি কর্পোরেশনকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, আসলে সবথেকে খারাপ যেটা হয়ে গেছে, অতীতের এই বক্সকালভার্টগুলো নির্মাণ করায়। যেখানে খাল রয়েছে সেখানে খালটা রেখে দুপাশে রাস্তা করা যেত। পিলার দিয়ে ওপর দিয়েও এলিভেটেড রাস্তা করা যেত। কিন্তু ব´কালভার্ট করার ফলে সেখানে যেমন ময়লা জমছে তেমনি জলাবদ্ধতারও সৃষ্টি হচ্ছে। আবার অনেক স্থানে এজমালি সম্পত্তির মত খাল দখল হয়ে ঘর-বাড়ি বা স্থাপনা বা দোকান-পাট তৈরী করা হয়েছে।
তিনি বলেন, মানুষের যেমন রক্ত প্রবাহের জন্য ধ্বমনি থাকে একটি শহরেরও তেমনি শিরা বা ধ্বমনি হিসেবে কাজ করে এই খালগুলো। কাজেই সেটা উদ্ধার করা একান্ত অপরিহার্য।
পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের জন্য ’৯৬ সালে সরকারে এসেই তাঁর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের ফ্লাট নির্মাণের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, শুরুটা আমরা করেছিলাম, কিন্তু, মাঝে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর সেগুলোকে এমনভাবে লুটে খেল যে, একটি বিল্ডিংও খাড়া হয়ে দাঁড়াতে পারল না। একটা আরেকটার ওপর ঢলে পড়ে যাচ্ছিল।
তখনকার বিএনপি’র সিটি মেয়র এবং সংশ্লিষ্টরা এই প্রকল্পের অর্থ আত্মস্যাৎ করে পুরো প্রকল্পের বারোটা বাজিয়ে দেন বলেও তিনি অভিযোগ করেন।
তাঁর সরকারের বস্তিবাসীর জন্য ভাড়া ভিত্তিক ফ্লাট নির্মাণের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বস্তিতে তারা মানবেতর জীবন যাপন করে। কাজেই, কোন নাগরিক কষ্টে থাক সেটা আমি চাই না। এ সময় তিনি হিজড়া, বেদে এবং কুষ্ঠরোগীদের জন্যও ঘরবাড়ি তৈরী করে জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা করে দেয়ায় তাঁর সরকারের পদক্ষেপসমূহ তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, মুজিববর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী আমরা কেবল উদযাপনের মধ্যদিয়ে নয়, জাতির পিতা এদেশ স্বাধীন করে গেছেন এবং তাঁর প্রতিটি নাগরিক যেন সুন্দর জীবন পায় সেটাই আমার লক্ষ্য। সেজন্য সকলকে আমরা ঘর করে দিচ্ছি।
এ সময় কোভিড-১৯ প্রতিরোধে তাঁর সরকারের নানাবিধ পদক্ষেপের পাশাপাশি দেশব্যাপী বিনে পয়সায় ভ্যাকসিন প্রদানেরও উল্লেখ করেন তিনি।
বিহারীরা পাকিস্তানে ফিরে যেতে চাইলেও পাকিস্তান সরকারের উদ্যোগ না থাকায় তাদের বাধ্য হয়ে জেনেভা ক্যাম্পের ছোট জায়গায় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাসের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, তাদের জন্য তিনি ভাল বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দেবেন।
তিনি বলেন, তারা খুব কর্মঠ, বিভিন্ন কাজ তারা খুব দক্ষতার সঙ্গে করতে পারেন। যে কারণে, আমি চাচ্ছি তাদের জন্য একটা ভাল বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়ার এবং তারা যে যে কাজে পারদর্শী নিজেদের সে কাজে সম্পৃক্ত করে যাতে জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা করতে পারে সে ব্যবস্থাটা আমাদের করতে হবে। কারণ, মানুষকে মানুষ হিসেবেই আমরা দেখতে চাই।
প্রয়োজনে ঢাকার বাইরে আরো বড় জায়গায় বা ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোনে, যেখানে কাজের ব্যবস্থা রয়েছে সেখানে এই পুণর্বাসনটা করা যেতে পারে বলেও তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন। সুত্র-বাসস।