সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা বিল সংসদে পাস
দেশের সব প্রাপ্ত বয়স্ক নাগরিককে পেনশন-ব্যবস্থার আওতায় আনতে জাতীয় সংসদে ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা বিল-২০২৩’ পাস হয়েছে। বিলে ১৮ বছর থেকে ৫০ বছর বয়সী সব নাগরিকের জন্য নির্ধারিত হারে চাঁদা পরিশোধ করে ৬০ বছর পূর্তির পর আজীবন পেনশন সুবিধা ভোগ করার বিধান রাখা হয়েছে।
এছাড়া বিশেষ বিবেচনায় পঞ্চাশোর্ধ্বরাও এই আইনের আওতায় নিরবচ্ছিন্ন ১০ বছর চাঁদা পরিশোধ করে পেনশন সুবিধা ভোগ করতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে স্কিমে অংশগ্রহণের তারিখ থেকে নিরবচ্ছিন্ন ১০ বছর চাঁদা দেওয়া শেষে তিনি যে বয়সে উপনীত হবেন, সে বয়স থেকে আজীবন পেনশন প্রাপ্য হবেন। আজীবন বলতে পেনশনারের বয়স ৭৫ বছর পর্যন্ত বিবেচনা করা হয়েছে।
মঙ্গলবার (২৪ জানুয়ারি) স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদ অধিবেশনে বিলটি পাস করার প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। পরে তা কণ্ঠভোটে পাস হয়। এর আগে বিলের ওপর আনীত জনমত যাচাই, বাছাই কমিটিতে প্রেরণ ও সংশোধনী প্রস্তাবগুলো কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায়। তবে কয়েকটি সংশোধনী গৃহীত হয়।
এর আগে বিলটি সরাসরি সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদের সাথে সাংঘর্ষিক উল্লেখ করে বিলটি পাস না করে ফেরৎ পাঠানো বা জনমত যাচাই-বাছাই কমিটিতে পাঠানোর পক্ষে বক্তব্য রাখেন বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ, ফখরুল ইমাম, মুজিবুল হক চুন্নু, পীর ফজলুর রহমান ও শামীম হায়দার পাটোয়ারি এবং স্বতন্ত্র সদস্য রেজাউল করিম বাবলু।
পেনশন আইনে বলা হয়েছে, চাঁদাদাতা ধারাবাহিকভাবে কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা দিলে মাসিক পেনশন পাবেন। চাঁদাদাতার বয়স ৬০ বছর পূর্তিতে পেনশন তহবিলে পুঞ্জীভূত মুনাফাসহ জমার বিপরীতে পেনশন দেওয়া হবে। বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি কর্মীরা এই কর্মসূচিতে অংশ নিতে পারবেন।
আইনে আরও বলা হয়েছে, নিম্ন আয় সীমার নিচের নাগরিকদের অথবা অস্বচ্ছল চাঁদাদাতার ক্ষেত্রে পেনশন তহবিলে মাসিক চাঁদার একটি অংশ সরকার অনুদান হিসেবে দিতে পারবে। একজন পেনশনার আজীবন পেনশন সুবিধা পাবেন। তবে পেনশনে থাকাকালীন ৭৫ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে মারা গেলে তার নমিনি অবশিষ্ট সময়ের জন্য (মূল পেনশনারের বয়স ৭৫ বছর পর্যন্ত) মাসিক পেনশন প্রাপ্য হবেন। চাঁদাদাতা কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা দেওয়ার আগে মারা গেলে জমা করা অর্থ মুনাফাসহ তার নমিনিকে ফেরত দেওয়া হবে।
বিলে আরও বলা হয়েছে, পেনশন তহবিলে জমা দেওয়া অর্থ কোনো পর্যায়ে এককালীন তোলার প্রয়োজন পড়লে চাঁদাদাতা আবেদন করলে জমা দেওয়া অর্থের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ঋণ হিসেবে তুলতে পারবেন, যা ফিসহ পরিশোধ করতে হবে।
আইনে পেনশন থেকে পাওয়া অর্থ আয়কর মুক্ত থাকবে এবং পেনশনের জন্য নির্ধারিত চাঁদা বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য করে কর রেয়াতের জন্য বিবেচিত হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতিতে সরকারি অথবা আধা সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত অথবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অংশ নিতে পারবে। এক্ষেত্রে কর্মী ও প্রতিষ্ঠানের চাঁদার অংশ কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করবে। তবে সরকারি সিদ্ধান্ত না দেওয়া পর্যন্ত সরকারি ও আধা সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরতরা পেনশন ব্যবস্থার আওতাবহির্ভূত থাকবে।
সরকার আইনের উদ্দেশ্য পূরণে প্রজ্ঞাপন জারি করে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা প্রবর্তন করবেন। এই আইন কার্যকর হওয়ার পর সরকার প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে পাঁচ সদস্যের একটি জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ গঠন করবে। যার প্রধান হবেন নির্বাহী চেয়ারম্যান। অপর চারজন কর্তৃপক্ষের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। এদের নিয়োগ করবে সরকার। তাদের চাকরির মেয়াদ ও শর্ত বিধি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে। কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ব্যয় সরকার নির্বাহ করবে। সরকারের অনুমোদন নিয়ে এ কর্তৃপক্ষ ঋণ নিতে পারবে বলে বিলে বলা হয়েছে।
এছাড়া আইনের পেনশন ব্যবস্থাপনার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ১৬ সদস্যের একটি পরিচালনা পর্ষদ গঠনের বিধান রাখা হয়েছে। এর চেয়ারম্যান হবেন অর্থমন্ত্রী। এতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব, অর্থ বিভাগের সচিব, এনবিআর চেয়ারম্যান, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব, সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান, এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি, এপ্লয়ার্স ফেডারেশনের সভাপতি, উইমেন চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি এর সদস্য হবেন। পর্ষদের সদস্য সচিব হবেন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান।
বিলের উদ্দেশ্য ও কারণ সম্বলিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদের দফা (ঘ) এর বিধান অনুযায়ী, সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার ও অন্যান্য অভাবগ্রস্থার ক্ষেত্রে নাগরিকদের সরকারি সাহায্য লাভের অধিকারের বিধান অন্তভুক্ত করে একটি পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণয়ন আবশ্যক। চলমান উন্নয়নের অগ্রযাত্রার সাফল্যের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা ও দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীরকে সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতায় আনার বিষয়টি নিশ্চিত কল্পে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন বিলটি প্রণয়ন করা সমচীন।