বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন জননেতা এবং আন্দোলনকারী মানুষ : আর্চার ব্লাড


ডেস্ক নিউজ
বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন জননেতা এবং আন্দোলনকারী মানুষ : আর্চার ব্লাড
  • Font increase
  • Font Decrease

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন প্রথমত একজন জননেতা  এবং আন্দোলনকারী  মানুষ। আজীবন সার্বক্ষণিক রাজনীতিবিদ এবং একজন সন্মোহনী বক্তা হিসাবে তিনি বৃষ্টি স্নাত শত সহস্র জনতাকে  আগুনের উত্তাপে আলোড়িত করতে পারেন।

১৯৭০  সালের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানের সার্বজনীন সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের পরপরেই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমেরিকার মূল্যায়ন ছিল এরকমই। তাদের বর্ণনায় শেখ মুজিব ছিলেন এক সন্মোহনী বক্তা, যিনি তাঁর রাজনৈতিক দক্ষতাকে কর্তৃত্বের সাথে কাজে লাগাতে পারেন। বাঙালিদের মধ্যে তাঁর এমন প্রতিদ্বন্ধী কেউ নেই, এমন বৈশিষ্টমন্ডিত কেউ নেই যিনি তাকে ছাড়িয়ে যাবেন।

আমেরিকান সাংবাদিক লেখক বি জেড খসরু‘র ইংরেজিতে লেখা ‘বাংলাদেশে মিলিটারি ক্যু সিআইএ লিঙ্ক’ গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু সর্ম্পকে  আর্চার ব্লাড এর এই মূল্যায়নের বিস্তারিত বর্ণনা আছে। গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন সিরাজ উদ্দিন সাথী। বাংলাদেশে দি ইউনিভার্সেল একাডেমি গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে।

আমেরিকান কূটনীতিকদের চোখে শেখ মুজিব তখন পাকিস্তানের ভবিষ্যত নেতা হিসাবে আবির্ভূত হয়েছেন। নির্বাচনের তিনদিন পর ১০ ডিসেম্বর ঢাকাস্থ আমেরিকান কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাড ওয়াশিংটনে বার্তা পাঠিয়ে শেখ মুজিব সর্ম্পকে তাদের মূল্যায়নে আরো লিখেন, ৭ ডিসেম্বর নির্বাচনে পূবর্ পাকিস্তান এক দলীয় রাজ্যে পরিণত হয়েছে। আওয়ামী লীগের এই অবাক করা বিজয় দলের বিজয়ের চেয়েও ব্যক্তির একক ভাবমূর্তির বিজয়। সকল ক্ষমতাশালী দলের কাছে অবিতর্কিত নেতা  হচ্ছেন শেখ মুজিবুর রহমান। যদিও এমন বিজয়ের খুব একটা অবাক হননি মুজিব। আমেরিকান কূটনীতিকদের ছয় মাস আগেই কথা প্রসঙ্গে এমন বিজয়ের সম্ভবনার কথা জানিয়েছিলেন তিনি।

আর্চার ব্লাড এখানেই থেমে থাকেননি। শেখ মুজিবের চারিত্রিক বৈশিষ্ট, গুণাবলী ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তিনি লিখেন- ‘মুজিব আজীবন সার্বক্ষণিক রাজনীতিবিদ। আমরা যতদুর জানি তিনি আইনের ডিগ্রি না নিয়েই বিশ^বিদ্যালয় ত্যাগ করেন। কখনো কোন চাকরি বা ব্যবসায় নিয়োজিত হননি। তার  দৃষ্টিগ্রাহ্য আয়ের উৎস হচ্ছে গ্রেট ইস্ট্রার্ণ লাইফ ইনসুরেন্স কোম্পানির উপদেষ্টা হিসাবে প্রাপ্ত অর্থ।’

একান্ত বৈঠক ও সাক্ষাতে তিনি (মুজিব) চমৎকার, শান্ত এবং আত্মপ্রত্যয়ী উল্লেখ করে আর্চার বলেন, ভুট্টোর মত বিশ্বজনীন আভিজাত্য তার নেই। তবে তিনি বহুদেশ ভ্রমন করেছেন এবং নাগরিক জীবনের মানুষ।

আর্চার লিখেন, মঞ্চে তিনি অনলবর্ষী বক্তা। বৃষ্টি স্নাত  শত সহস্র জনতাকে তিনি আগুনের উত্তাপে আলোড়িত করতে পারেন। দলনেতা হিসাবে তিনি কঠোর ও কতৃত্ববাদী, প্রায়শই বেপরোয়া। মুজিবের মধ্যে আছে  মসীহর মতো জটিল দিক। জনতোষণ ও মনোরঞ্জনের জন্য ব্যাপক কর্মসূচির অভিজ্ঞতায় তা ক্রমশ আরো জোরদার হয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর কথাবলার ধরণ নিয়েও আর্চার কথা বলেন। তিনি বলেন, শেখ মুজিব কথা বলেন,‘আমার লোক, আমার জমি, আমার বন, আমার নদী উচ্চারণে। এতে স্পষ্ট মনে হয় তিনি নিজকে পরিচয় দেন বাঙালির আশা ভরসার ব্যক্তি হিসাবে। মুজিব যখন বাঙালির দুঃখবেদনার কথা বলেন তখন তিনি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। তাকে নিয়মানুগ চিন্তাবিদ বলে মনে হয়না, বরং তাকে  নিয়ম ভাঙ্গার মেজাজের অধিকারী বলেই বেশী  মনে হয়। তবে বঙ্গবন্ধুকে প্রথমত একজন জননেতা,আন্দোলনকারী মানুষ হিসাবে অভিহিত করেন আর্চার।

অন্যদিকে নিন্দুকেরা  বঙ্গবন্ধু সর্ম্পকে কি ধারণা করে তাও তুলে ধরেন আর্চার। নিন্দুকদের মতে শেখ মুজিবের বুদ্ধিবৃত্তিক গভীরতা ছিল কম এবং ক্ষমতার জন্য লোভী। এর জবাবে অবশ্য আর্চার বলেন, যদিও তিনি বুদ্ধিজীবী নন তবুও একান্ত বৈঠকে  মুজিব উল্লেখযোগ্য মানসিক চৌকষতা প্রদর্শন করে থাকেন এবং তাঁর রসবোধও যথেষ্ট।

তবে ১৯৭৩ সালে আমেরিকান মিশন বঙ্গবন্ধুর মূল্যায়নে আগের অবস্থান থেকে একটু সরে আসে বলে মনে করা যেতে পারে। মিশনের মতে শেখ মুজিব রাজনৈতিক জীবনে বৈদেশিক নীতি বা বিষয়াবলি নিয়ে খুব একটা মনযোগ দেন নাই।

তিনি যেভাবে বিশ্বকে বিশ্লেষণ করেছেন তাতে বিশ^জনীন  বিষয়ে গভীর উপলব্দি ছিলনা  বলেই মনে হয়। এই সময় মিশন লেখে ‘সর্বোপরি তিনি ( মুজিব) ছিলেন  প্রাদেশিক বিরোধী দলীয় রাজনৈতিক। এর থেকে তিনি রাষ্ট্রপ্রধান হন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে আমেরিকান বিরোধী নন। তিনি আমেরিকা কিংবা এর উদ্দেশ্যবলির  বিরোধীতা করেন না। তবে যারা তীব্র শব্দ করেন, তাদের চড়কায় তিনি তেল দেন। সোভিয়েট ইউনিয়ন ও ভারতের কথা বলা যায় এক্ষেত্রে।’

ধারণা করা যায় ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু জোট নিরপেক্ষতায় নিজেকে জড়িয়ে নেয়া এবং জোট নিরপেক্ষ সন্মেলনে যোগ দেয়ার কারণে আমেরিকার দৃষ্টিভঙ্গিজনিত ধারণায় এই মূল্যায়ন আসে। তবে মিশন এটাও বলেছে  আমেরিকানদের কাছে তিনি পাকিস্তান সময় থেকেই  উদারবাদী নেতা হিসাবে পরিচিত ছিলেন। একমাত্র ব্যতিক্রম হিসাবে তারা দেখেছেন পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রশ্নে চরম অবস্থান নেয়ায়।

যদিও বঙ্গবন্ধু একটা সময়ে স্বায়ত্তশাসনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেননি। চুড়ান্ত পর্যায়ে তিনি স্বাধীনতা চেয়েছেন এবং ন্বাধীনতার ঘোষণাও দেন। বঙ্গবন্ধুর সেই ডাকে সারা দিয়ে বাঙালি নয়মাস পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে  যুদ্ধ করে বাংলাদেশ স্বাধীন করে। সুত্র-বাসস।