আবাসিক এলাকা থেকে কেমিক্যাল কারখানা, দোকান ও গুদাম অপসারণের দাবি
পুরান ঢাকায় একের পর এক কেমিক্যাল কারখানায় অগ্নিকান্ডে অসংখ্য মানুষ হতাহত হলেও আজ পর্যন্ত তেমন কার্যকর কোন পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছেনা বরং আবাসিক এলাকায় বেনামে হাজারো কেমিকেল দোকান, গুদাম ও কারখানা গড়ে উঠেছে যা অবিলম্বে অপসারণ করা উচিত বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন-পবা’র অনলাইন আলোচনা সভায় বক্তারা।
পুরান ঢাকায় একের পর এক কেমিক্যাল কারখানায় অগ্নিকান্ডে অসংখ্য মানুষ হতাহত হলেও আজ পর্যন্ত তেমন কার্যকর কোন পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছেনা বরং আবাসিক এলাকায় বেনামে হাজারো কেমিকেল দোকান, গুদাম ও কারখানা গড়ে উঠেছে যা অবিলম্বে অপসারণ করা উচিত বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন-পবা’র অনলাইন আলোচনা সভায় বক্তারা।
শনিবার পবা'র চেয়ারম্যান আবু নাসের খানের সভাপতিত্বে ও সম্পাদক মেসবাহ সুমনের সঞ্চালনায় বেলা ১২ টায় অনুষ্ঠিত অনলাইন আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ কেমিক্যাল সোসাইটির সাবেক সভাপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ইউজিসি প্রফেসর ড. এম, মুহিবুর রহমান। পরিবেশ বার্তার সম্পাদক ফেরদৌস আহমেদ উজ্জ্বল, প্রকৌশলী মো: আবদুস সোবহান, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক, পরিবেশ অধিদপ্তর ও সাধারণ সম্পাদক, পবা। আইনজীবী ও নীতি বিশ্লেষক সৈয়দ মাহবুবুল আলম তাহিন। পবার সম্পাদক, ব্যারিস্টার নিশাত মাহমুদ। বানিপার সভাপতি প্রকৌ: মো: আনোয়ার হোসেন, আমির হাসান মাসুদ, সভাপতি, পরিবেশ আন্দোলন মঞ্চ, মো: শহিদুল্লাহ, সভাপতি, ঢাকা যুব ফাউন্ডেশন, মাহমুদ আহমেদ মুসলিম, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, ঢাকা মহানগর সমিতি, আশিক উদ্দিন সৈনিক, চুড়িহাট্টা অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার সংস্থার সাধারণ সম্পাদক।
গতকাল (২৩ এপ্রিল ২০২১ )দূর্ঘটনার পরপরই, পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খানের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল আরমানিটোলায় দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এসময় তারা খেয়াল করেন, দুর্ঘটনা কবলিত হাজী মুসা ম্যানশনের নীচ তলায় কেমিকেল দোকান রয়েছে সর্বমোট ১৬ টি। যারা মূলত বহুজাতিক কেমিকেল উৎপাদন করে থাকে। পবা'র প্রতিবেদক দল তার মধ্যে এসিটিক এসিডের নাম সনাক্ত করতে পেরেছে। কারণ ঐ মুহূর্তে বেশির ভাগ দোকানই বন্ধ থাকায় এটি জানা যায়। এই উল্লেখ্য যে এই দোকানগুলো চুরিহাট্টার সংঘটিত ভয়াবহ দূর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের নানামুখী তৎপরতার কারণে এই জাতীয় কেমিক্যাল দোকানগুলো এখান থেকে সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়। পরবর্তীতে সুযোগসন্ধানী মহল পুনরায় এই স্থানে ব্যবসায়ীক উদ্দেশ্য নিয়ে ফিরে আসে।
আলোচনা সভায় বক্তারা বলেন, গত ২৩ এপ্রিল দিবাগত রাতে পুরান ঢাকার আরমানীটোলায় আবার ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে এই ঘটনায় এতোমধ্যে ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন অসংখ্য মানুষ। আলোচনা সভায় বক্তারা বলেন, গত ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ চকবাজারের চুড়িহাট্রায় ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে যে বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল সেই দূঘর্টনার আগুন কেড়ে নিয়েছিল ৭১টি তরতাজা প্রাণ। পবা'র একটি প্রতিনিধিদল সেসময় সরেজমিনে চুড়িহাট্রার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ও ২৪ ফেব্রুয়ারী একটি সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এর আগে নিমতলীতে ২০১০ সালে অগ্নিকান্ডে ১২৪ জনের প্রাণহানি ঘটে। এই দূর্ঘটনার পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পুরানো ঢাকা থেকে কেমিকেল গোডাউন, কারখানা ও দোকান সরানোর জন্য নির্দেশ দেন।
কিন্তু আমরা লক্ষ্য করেছি যে পুরানো ঢাকার চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনায় নিহতের স্বজনেরা এখনো স্বাভাবিক হতে না পারলেও পুরানো ঢাকা এখন স্বাভাবিক। আগের মতো রাসায়নিক গোডাউন রয়েছে প্রায় প্রতিটি বাড়িতে। প্রতিটি বাড়ি যেন একেকটি বোমা ঘর। আগুনের পর এলাকা থেকে রাসায়নিকের গোডাউন সরানোর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। কিন্তু ওই পর্যন্তই। এরপর চুড়িহাট্টায় আগুন লাগলে রাসায়নিকের গুদামগুলো সরানোর তোড়জোড় দেখা যায় আবারো। এবারও ফলাফল আগের মতোই।
পুরানো ঢাকায় প্রায় ২৫ হাজার কেমিক্যাল গোডাউন আছে। এর মধ্যে বৈধ মাত্র আড়াই হাজার। এসব দুর্ঘটনা ঘটার পর এসব রাসায়নিক গোডাউন সরানোর কথা আলোচনা হলেও বাস্তবে এর গ্রতিফলন নেই। বাড়ির মালিকরা শুধু মাত্র বেশি ভাড়ার লোভে এসব গোডাউন ভাড়া দিয়ে থাকেন। ফলে ক’দিন পর পর ঘটে দুর্ঘটনা। প্রাণ হারায় নিরীহ মানুষগুলো। ভয়াবহ ওই অগ্নিকান্ডের পর বুয়েট, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয় এবং ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন পৃথকভাবে তদন্ত করে বিভিন্ন সুপারিশ সংবলিত প্রতিবেদন দেয়। প্রায় সব প্রতিষ্ঠানই পুরানো ঢাকার আগুনের ঝুঁকি মোকাবিলায় রাসায়নিকের গোডাউন ও কারখানা অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার সুপারিশ করে। কিন্তু ঘটনার দুই বছর অতিবাহিত হলেও সুপারিশ বাস্তবায়নের দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। নিমতলীর ঘটনার পর যারা বিগত ১১ বছরে দায়িত্ব অবহেলা করেছে তাদের বিষয়ে তদন্ত করে বিচারের আওতায় আনা উচিত। সরকারী ও বেসরকারী সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে বিভিন্ন সময়ে গঠিত কমিটিগুলোর সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হবে।
শহরে যে কোন ব্যবসার জন্য সিটি কর্পোরেশনের লাইন্সেস নিতে হয়। রাসায়নিক আমদানী ও মজুতের ক্ষেত্রে বিস্ফোরক অধিদপ্তরের অনুমোদন প্রয়োজন। আর কারখানা স্থাপনে ফায়ার সার্ভিস এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন প্রয়োজন। এছাড়া কারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তর শ্রমিকদের নিরাপত্তা এবং মান নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে আছে। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর আইন ও নীতিমালা বাস্তবায়নে জনবল ও বাজেটে কোন ঘাটতি রয়েছে কি না, সংস্থাগুলোর বিগত দিনে দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের দায়িত্বে অবহেলা বা অসহযোগিতা করেছে কি না অথবা ব্যবসায়ীরা সরকারী সংস্থাগুলোর ক্ষমতাকে অবজ্ঞা করছে কি না, তাও খুঁজে দেখা জরুরি। পুরাতন ঢাকার স্থানীয়/এলাকার জনগন সজাগ না হলে কিছুই করা যাবেনা। তাদের সচেতন হতে হবে প্রতিবাদ করতে হবে। পরিবেশ আদালতে গিয়ে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
অনলাইন আলোচনা থেকে পবা’র সুপারিশসমূহ:
১. আইন লঙ্ঘন করে রাসায়নিক কারখানা এবং অন্যান্য দাহ্য উপকরনের গোডাউন স্থাপন এবং ভাড়া প্রদানকারী বাড়ীর মালিক ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন করা।
২. বিদ্যমান আইন এবং রাসায়নিক কারখানা সরানোর জন্য শিল্প মন্ত্রণালয়, শ্রম মন্ত্রণালায়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সিটি কর্পোরেশন, পরিবেশ অধিদপ্তর, বিস্ফোরক অধিদপ্তর, কারখানা পরিদর্শকের অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মতো সংস্থাগুলোর দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের দায়িত্বে অবহেলা বা অসহযোগিতা করেছে কি না অথবা ব্যবসায়ীরা সরকারী সংস্থাগুলোর ক্ষমতাকে অবজ্ঞা করছে কি না, তা বের করতে তদন্ত কমিটি গঠন ও প্রতিবেদন প্রকাশ।
৩. রাজউক যে উদ্দেশ্যে ব্যবহারের জন্য একটি ভবনের নক্সা অনুমোদন করে, ভবনটি সেই উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে কিনা সেটি মনিটারিং করা ও বিধি লংঘনকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক। পুরান ঢাকায় বিল্ডিং কোড এর পূর্ণ বাস্তবায়ন করা।
৪. পুরান ঢাকার সকল রাসায়নিক কারখানা, রাসায়নিক এবং অন্যান্য দাহ্য উপকরনের গোডাউনের তালিকা হালনাগাদ করা। বিপদজনক কারখানা ও গোডাউন দ্রুততম সময়ের সরকার পরিকল্পিত নির্ধারিত স্থানান্তর করতে হবে।
৫. কেমিক্যাল স্থাপনাগুলো যেন পরিবেশ দূষণ এবং বিপজনক অবস্থা সৃষ্টি করতে না পারে যে জন্য ব্যবসায়ীদের অবকাঠামো এবং স্থাপনার উপর সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর নজরদারি রাখা।
৬. পুরানা ঢাকার সরু রাস্তায় চলাচলের উপযোগী ফায়ার সার্ভিসের বিশেষ গাড়ী ক্রয় এবং শুধূ পানি দিয়ে নয় ক্যামিক্যাল ও ইলেকট্রিক আগুন নেভানোর আধুনিক ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা করা।
৭. পানির সমস্যা সমাধানের রাস্তার মোড়ে মোড়ে ফায়ার হাইড্রেন্ট (জরুরি অবস্থায় পানি পাওয়ার ব্যবস্থা) স্থাপন করা।
৮. কেবল মাত্র একজন উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত রসায়ন বিষয়ে ন্যুনতম জ্ঞান সম্পন্ন ব্যক্তির তত্বাবধান রাসায়নিক দ্রব্যের উৎপাদন, বিপনন, গুদামজাতকরণ এর জন্য বাধ্যতামূলক করা।
৯. লোকলয়ে রাসায়নিক দ্রব্যাদির গুদামজাত করণ, বিপনন ও উৎপাদন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হোক। রাসায়নিক বর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করা।