গোটা পরিবার একটি হত্যাকণ্ডের সঙ্গে জড়িত

২০১৭ সালের ১০ ডিসেম্বর রাজধানীর আফতাব নগরের নিজ বাসায় খুন হন মনজিল হক। হত্যাকাণ্ডের তিন বছর পর এর রহস্য উন্মোচন করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে যে দৃশ্যপট পুলিশ তুলে ধরছে তাতে দেখা যাচ্ছে গোটা পরিবার এ হত্যাকণ্ডের সঙ্গে জড়িত।

গোটা পরিবার একটি হত্যাকণ্ডের সঙ্গে জড়িত

২০১৭ সালের ১০ ডিসেম্বর রাজধানীর আফতাব নগরের নিজ বাসায় খুন হন মনজিল হক। হত্যাকাণ্ডের তিন বছর পর এর রহস্য উন্মোচন করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে যে দৃশ্যপট পুলিশ তুলে ধরছে তাতে দেখা যাচ্ছে গোটা পরিবার এ হত্যাকণ্ডের সঙ্গে জড়িত।

সিআইডি বলছে, সৎ ভাই, সৎ মা, মামা ও চাচার পরিকল্পনায় খুন হন মনজিল। হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনায় থাকলেও পরে মনজিলের চাচা ফারুক মিয়া নিজেই মনজিল হত্যায় বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন। হত্যাকাণ্ডের পর আত্মগোপনে চলে যান সৎ ভাই ইয়াসিন। এজন্য নিখোঁজ ইয়াসিনের সন্ধান চেয়ে থানায় জিডি করে কৌশল অবম্বলন করে খুনি পরিবার।

হত্যাকাণ্ডের তদন্তে নেমে নিখোঁজ সৎ ভাই ইয়াসিনকে খুঁজতে থাকে সিআইডি। চলতি বছরের ১৩ মার্চ চট্টগ্রামের শেরশাহ কলোনি থেকে গ্রেফতার হন তিনি। এরপর জট খুলতে থাকে মনজিল হত্যার। মূলত ইয়াসিনের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে একে একে গ্রেফতার করা হয় হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত ভাড়াটে খুনি রবিউল ইসলাম সিয়াম, মাহফুজুল ইসলাম রাকিব, সীমান্ত হাসান তাকবীরকে।

রোববার দুপুরে মালিবাগে সিআইডি কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ ওমর ফারুক।

সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, মনজিলের বয়স যখন ৩/৪ বছর, তখন মনজিলের বাবা মইনুল হক অনৈতিক সম্পর্কে জড়ান। মনজিলের বাবা যার সাথে অনৈতিক সম্পর্কে জড়ান তিনি মনজিলের মায়ের খালাতো বোন ছিলেন। তার নাম লায়লা ইয়াসমিন লিপি। মইনুল হক তাদের শান্তিনগরের বাসায় মনজিলের মা সাদিয়া পারভীন কাজলের গায়ে কোরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে হত্যা করেন। মনজিলের মায়ের মৃত্যুর পর প্রেমিকা লায়লা ইয়াসমিন লিপিকে বিয়ে করে সংসার শুরু করেন মইনুল।

শান্তিনগরের এই ফ্ল্যাটটি ছিল মনজিল, ইয়াসিন এবং ফারুক মিয়ার ছেলে একেএম নেওয়াজের নামে যৌথ মালিকানার। ওই ফ্ল্যাটে মনজিলের মা ও মনজিলকে নিয়ে প্রথমে বসবাস করতেন মইনুল। দ্বিতীয় বিয়ের পর প্রথম ছেলে মনজিল ও ২য় স্ত্রী লায়লা ইয়াসমিন এবং তার সন্তান ইয়াসিনকে নিয়ে সেখানে থাকতেন তিনি।

ইয়াসিনের বয়স যখন ১২/১৩ বছর তখন মনজিলের বাবা ফ্ল্যাটটি ইয়াসিন ও মনজিলের নামে দলিল করিয়ে গোপনে বিক্রি করে দেন। ভাই ফারুক মিয়া তখন ফ্ল্যাট বিক্রির টাকা থেকে তার ছেলে নেওয়াজের অংশ দাবি করেন। এতে অসন্তুষ্ট হয়ে মনজিল ও মনজিলের বাবা ফারুক মিয়াকে মাদকাসক্ত বলে প্রচার করেন এবং বাড্ডায় সেতু নামক একটি মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে ২ মাস ২১ দিন আটকে রাখেন।

ফারুক মিয়ার লন্ডন প্রবাসী ছেলে নেওয়াজ পরে তাকে উদ্ধার করেন। এ বিষয়ে ফারুক মিয়া কোনো মামলা দায়ের করেননি। তবে মনজিলের বাবার মৃত্যুর পর সম্পত্তি বাগাতে ও আগের লাঞ্ছনার শোধ তুলতে ফারুক মিয়া ইয়াসিন ও ভাড়াটে তিন খুনিকে দিয়ে মনজিলকে হত্যার পরিকল্পনা করেন বলে মামলাটির গোপনীয় তদন্ত ও সাক্ষ্য প্রমাণে জানা যায়।

তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পারে, মনজিল তার বাবার মৃত্যুর পর মৃত মায়ের স্বর্ণালঙ্কার ফিরে পেতে সৎ মা লায়লা ইয়াসমিন লিপিকে চাপ দেয়। লিপি মনজিলকে জানায়, স্বর্ণালংকার তার ভাই আবু ইউসুফ নয়নের কাছে আছে। আবু ইউসুফ নয়ন গহনাগুলো ফেরত না দিলে মনজিল রাজারবাগের বাসায় আবু ইউসুফ নয়নকে লাঞ্ছিত করে।

এরপরই মূলত শুরু হয় মনজিল হত্যার পরিকল্পনা। ইয়াসিন তার সৎ ভাই মনজিলকে হত্যার পরিকল্পনার বিষয়ে মামা আবু ইউসুফের সঙ্গে পরামর্শ করলে তিনি সম্মতি দেন এবং হত্যার কাজে খরচ করার জন্য ইয়াসিনকে ২০ হাজার টাকাও দেন।

এরপর খুনের পরিকল্পনা শুরু করে ইয়াসিন হক। মা লিপি, মামা আবু ইউসুফ এবং মামলার বাদী চাচা ফারুক মিয়ার সাথে পরামর্শ করে খুনের আগের দিন ২০১৭ সালের ১০ ডিসেম্বর ভাড়াটে তিন খুনি ইয়াসিন হকের বনশ্রীর পৈত্রিক ফ্ল্যাটে রাত্রিযাপন করেন। সেখানে গোপন বৈঠক হয় এবং ৫ লাখ টাকায় খুনের চুক্তি হয়।

খুনের দিন মনজিলের বাসায় দারোয়ান ছাড়া কেউ ছিল না। এই সুযোগে সকালে মনজিলের বাসায় ঢুকে ইয়াসিনের উপস্থিতিতে তিন ভাড়াটে খুনি মনজিলকে জিম্মি করে গলা কেটে হত্যা করে। এ ঘটনায় চাচা ফারুক মিয়া বাদী হয়ে বাড্ডা থানায় মামলা করেন। পরের বছর ২৪ মার্চ মামলাটির তদন্তভার পায় সিআইডি।

সিআইডি তদন্ত কার্যক্রম শুরুর পর থেকেই মামলার বাদী অসহযোগিতা করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য প্রভাবিত করে আসছিলেন বলে জানান অতিরিক্ত ডিআইজি ওমর ফারুক।

তিনি বলেন, মনজিল হকের সৎ ভাই ইয়াসিন হক ঘটনার দিন থেকে নিখোঁজ হন। এ ঘটনায় ইয়াসিন হকের মামা আবু ইউসুফ নয়ন রামপুরা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। নিখোঁজ ইয়াসিনের সন্ধান না পাওয়ায় মনজিল খুনের সূত্রও পাওয়া যাচ্ছিল না। অজ্ঞাতনামা খুনিরা নিখোঁজ ইয়াসিন হককে অপহরণপূর্বক খুন করে লাশ গুম করেছে মর্মে মিথ্যা তথ্য দিয়ে সিআইডিকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হয়।

সিআইডি কর্মকর্তা ওমর ফারুক বলেন, এক পর্যায়ে জানা যায় ইয়াসিন হক প্রকৃত নাম গোপন করে ছদ্ম নাম ব্যবহার করে চট্টগ্রামে দৈনিক জাগরণী পত্রিকার জেলা রিপোর্টার হিসেবে কাজ করছেন। সেই সূত্র ধরে চট্টগ্রাম মহানগরীর শেরশাহ কলোনি থেকে চলতি বছরের মার্চে ইয়াসিন হককে গ্রেপ্তার করা হয়।

সিআইডির এ কর্মকর্তা জানান, খুনি ইয়াসিন হকের মা লায়লা ইয়াসমিন লিপি, মামা আবু ইউসুফ নয়ন এবং মামলার বাদী ফারুক মিয়াকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে।

তার দেওয়া তথ্য মতে ভাড়াটে খুনি রবিউল ইসলাম সিয়াম, মাহফুজুল ইসলাম রাকিব এবং সীমান্ত হাসান তাকবীরকে একে একে গ্রেফতার করা হয়। তাদের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে ঘটনাস্থল থেকে প্রাপ্ত আলামতে থাকা ডিএনএ প্রোফাইলের সাথে পরীক্ষা করলে মিল পাওয়া যায়।

তারা প্রত্যেকে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। মনজিল হককে ধারালো ছুরি দিয়ে গলা কেটে, পেটে ছুরি চালিয়ে এবং হাত পায়ের রগ কেটে নৃশংসভাবে খুন করার কথা স্বীকার করেন সবাই।

প্রকৌশল নিউজ/এমআরএস