নারায়ণগঞ্জ : ডিএনএ নমুনা পরীক্ষায় লাশ শনাক্ত হবে, নিখোঁজ ৫১
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের ভুলতায় সজীব গ্রুপের হাশেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজের ফুডস ফ্যাক্টরিতে (সেজান জুসের কারখানা) বৃহস্পতিবার পৌনে ছয়টার দিকে আগুন লাগে। আগুন নিয়ন্ত্রণে যোগ দেয় ফায়ার সার্ভিসের ১৮টি ইউনিট। রাতেই তিন শ্রমিকের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। শুক্রবার সকাল ১০ টার দিকে কারখানার চতুর্থ তলার ফ্লোরের কলাপসিবল গেটের তালা ভেঙ্গে ভিতর থেকে একে একে উদ্ধার হতে থাকে লাশ। একটি নয়; দুইটি নয়; ৪৯ টি লাশ। কারাখানার আগুনে লাশগুলো পুড়ে বিকৃত হয়ে গেছে। চেনারও উপায় নেই যে কোন লাশ কার। আগুন লাগার পর কারাখানায় নিয়োজিত কর্মীরা ৪র্থ তলার কলাপসিবল গেটে তালাবদ্ধ করে দেয়ায় সেখানকার শ্রমিকরা বের হতে পারেনি। দগ্ধ হয়েই চতুর্থ তলার ফ্লোরেই ৪০ জনের মৃত্যু হয়। মৃত্যু হওয়া বেশিরভাগ শ্রমিক শিশু বলে জানা গেছে। কারখানা নির্মাণে কোনো শর্তই মানা হয়নি। ভবনটিতে ছিল না কোনো অগ্নিনির্বাপনের ফায়ার স্টুইংগুইসার। প্রতিটি ফ্লোরে কেমিকেলের বস্তায় ঠাসা ছিল।
ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা বিভাগের উপ-পরিচালক দেবাশীষ বর্ধন এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, চার তলার ফ্লোরে প্রবেশমুখে মোটা জিআই তার দিয়ে তৈরি নেটের সার্টার দিয়ে তালাবদ্ধ ছিল। ফায়ার সার্ভিস নেটের সার্টার কেটে ভিতরে প্রবেশ করে লাশগুলো উদ্ধার করেছে। তবে শুক্রবার রাত ৯ টার দিকে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কারখানার ৫ম ও ৬ষ্ঠ তলার ফ্লোরের আগুন নিভিয়ে ফেলে ফায়ার সার্ভিস।
ঘটনাস্থল থেকে রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহ্ নুসরাত জাহান বলেন, আগুন মোটামুটি নিয়ন্ত্রনে আনার পর ফায়ার সার্ভিস ৫ম তলা ও ৬ষ্ঠ তলায় প্রাথমিকভাবে তল্লাশি চালিয়ে কোনো লাশ পায়নি। শাহ এর আগে শুক্রবার সকালে অগ্নি নির্বাপনে অবহেলার অভিযোগ এনে শ্রমিকরা বিক্ষোভ মিছিল করে। এতে পুলিশের সাথে শ্রমিকদের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পুলিশ শর্টগান দিয়ে গুলি করে বিক্ষোভরত শ্রমিকদের সরিয়ে দেয়। এতে অন্তত ১০ জন শ্রমিক আহত হয়।
করোনার লকডাউনের মধ্যে ঈদুল আজহার আগে এই মর্মান্তিক ঘটনায় রূপগঞ্জে কারখানার শ্রমিকদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। শুক্রবার বিকাল তিনটা পর্যন্ত ৫১ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করে পাঁচটি এ্যাম্বুলেন্স করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠায়। আগুনে লাশ বিকৃত হয়ে যাওয়ায় স্বজনরা শনাক্ত করতে পারেননি। ফলে কারাখানার সামনে দিনভর ছিল নিখোঁজদের খুঁজে বের করার আকুতি জানিয়ে স্বজনদের আহাজারি।
নারায়ণগঞ্জ জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক শামীম বেপারি বলেন, লাশ শনাক্ত করার জন্য ডিএনএ নমুনা পরীক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গ থেকে লাশের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে রাখা হবে। এরপর স্বজনদের ডিএনএ নমুনা পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া যাবে যে কার লাশ কোনটি।
কারখানায় আগুনের ঘটনায় সাত সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা হলেন, নারায়ণগঞ্জ অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) শামীম ব্যাপারী, নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের প্রতিনিধি, রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার শাহ্ নুসরাত জাহান, ফায়ার সার্ভিসের প্রতিনিধি ও কলকারখানা পরিদর্শক সহ ৭ সদস্য কমিটি গঠন করা হয়েছে। তবে প্রয়োজনে কমিটির সদস্য সংখ্যা বর্ধিত করা হতে পারে বলে জানা গেছে।
এদিকে জেলা প্রশাসনের তহবিল থেকে নিহতদের পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা ও আহতদের চিকিৎসার জন্য ১০ হাজার টাকা করে অনুদানের ঘোষণা দিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ। এছাড়া কারখানার মালিক পক্ষ থেকে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী হতাহতদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন।
যেভাবে আগুনের সূত্রপাত : সেজান জুস কারখানায় ৭ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। করোনার কারণে কারখানার কয়েকটি ইউনিট বন্ধ রয়েছে। কারখানার ষ্টোরেজ, কার্টন ও ফুড সেকশন ছয় তলায়। সেখানে চার শতাধিক শ্রমিক কাজ করছিলেন। শতাধিক শ্রমিক দোতলায় ফুড প্যাকেজিংয়ে কাজ করেন। তৃতীয় তলায় কার্টন সেকশন, লাচ্ছি ও লিচু সেকশন। দোতলায় টোস্ট সেকশন লকাডাউনের কারণে কারখানা আংশিক চলমান ছিল। সে কারণে ঘটনার দিন কর্মরত ছিল তিন হাজার শ্রমিক। তাদের অধিকাংশের বয়সই ১৮ বছরের নিচে। তারা সবাই নিন্ম আয়ের মানুষ। ভবনের তৃতীয় তলায় কার্টন সেকশন থেকে থেকে বৃহস্পতিবার পৌণে ৬ টার দিকে আগুনের সূত্রপাত হয়। আগুনের খবর ছড়িয়ে পড়লে চতুর্থ তলার ফ্লোরের নিরাপত্তা কর্মীরা কলাপসিবল গেটের নেটের সার্টার নামিয়ে তালা ঝুলিয়ে দেয়। প্রথম দফায় ফায়ার সার্ভিসের ৪ টি ইউনিট গিয়ে আগুন নেভানোর কাজ শুরু করে। ওই সময় কিছু সংখ্যক শ্রমিক ভবন থেকে লাফিয়ে আত্মরক্ষা করে। লাফিয়ে পড়া শ্রমিকদের মধ্যে ৩ জনের মৃত্যু হয়। রাত যত গভীর হতে থাকে আগুনের লেলিহান শিখা প্রকান্ড আকার ধারণ করতে থাকে। ফায়ার সার্ভিসের ১৮ টি ইউনিট একযোগে আগুন নেভানোর চেষ্টা করতে থাকে। শুক্রবার সকাল ৯ টার দিকে ভবনের নিচতলা থেকে চার তলা পর্যন্ত আগুন নিভিয়ে ফেলে ফায়ার সার্ভিস। আগুনে ভবনের ফাটল দেখা দেয়। এরকম নানা প্রতিকুলতায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা প্রায় ২৬ ঘন্টা একটানা চেষ্টা চালিয়ে শুক্রবার রাত ৮ টার দিকে আগুন নিভিয়ে ফেলে।
শ্রমিকদের বিক্ষোভ :
সকাল সাড়ে ১০ টায় বিভিন্ন অভিযোগে শ্রমিকদের স্বজনরা ক্ষিপ্ত হয়ে কারখানার অফিসকক্ষে ও নিরাপত্তাকর্মীদের লক্ষ্য করে ইট পাটকেল নিক্ষেপ করে। একপর্যায়ে পার্শবর্তী ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের কর্ণগোপ এলাকায় তারা অবস্থান নেয়। গাড়ি ভাংচুর করে। নিরাপত্তাকর্মীদের বেদম প্রহার করে তাদের তিন জনের অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে পার্শবর্তী জলাশয়ে ফেলে দেয়। পরে দু’টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। এসময় পুলিশ ধাওয়া করে উত্তেজিত শ্রমিক ও তাদের স্বজনদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পুলিশ শর্টগান দিয়ে গুলি করলে হাসিবুল আলমসহ ১০ জন শ্রমিক আহত হন।
স্বজনদের আহাজারি :
স্বজনদের খুঁজতে আসা মানুষের আহাজারিতে আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠে। দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা কারখানার সামনে স্বজনরা বিলাপ করতে থাকেন। কেউ ছুটছেন স্বজনের খোঁজে। শোকে কেউ কেউ অজ্ঞান হয়ে পড়েন। কেউবা বাকরুদ্ধ। কেউবা নিরবে দাঁড়িয়ে আছেন ভবনের পাশে। আবার কেউ কেউ মুর্ছা যাওয়া স্বজনদের পার্শবর্তী হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন। কেউবা উত্তেজিত হয়ে কারখানার কর্মকর্তাদের খোঁজেন। নেত্রকোনা জেলার বাসিন্দা শান্তা মনি (১২) গত দেড় বছর ধরে এখানে চাকরি করে। তার মা শিমু আক্তার মেয়ের খোঁজে বিলাপ করে কাঁদছেন। মাঝে মধ্যেই মূর্ছা যাচ্ছেন। এমনি করেই শ্রমিক পারভেজের (২০) মা ফরিদা, অমৃতার (২৫) স্বামী সেলিম মিয়া, রাবেয়ার (২০) পিতা চান্দু মিয়া, রহিমার (২৯) স্বামী কালাম মিয়াসহ আরো অনেকেই স্বজনদের জন্য আহাজারি করছেন।
নিখোঁজ ৫১ জন :
স্বজনদের দেয়া তথ্য অনুযায়ি নিখোঁজ রয়েছেন ৫১ জন। তাদের ৩৩ জনের পরিচয় মিলেছে। তারা হচ্ছে ভোলা জেলার মহিউদ্দিন, শামীম, রাকিব হোসেন, মোঃ হাসাইন, হাফেজ, রাকিব, নোমন মিয়া, নারায়ণগঞ্জের ফিরোজা বেগম, আমেনা, ফিরোজা খাতুন, রিমা, নাজমা বেগম, পাবনার মোহাম্মদ আলী, কিশোরগঞ্জের নাঈম, ফারজানা আক্তার, নাজমুল হাসান, তাসলিমা, সাহিদা, খাদিজা, সেলিনা, আকলিমা, শাহানা, মিনা খাতুন, ফাতেমা আক্তার, জামালপুরের জিহাদ রানা, চাঁদপুরের পারভেজ, রাজশাহীর মাহবুব, গাজীপুরের রিপন মিয়া, নেত্রকোনার শান্তা মনি, নবীগঞ্জের উর্মিতা বেগম, খালিয়াঝুড়ির হিমা, রংপুরের স্বপন, মৌলভীবাজারের কম্পা বর্মন।
প্রত্যক্ষদর্শী ও কর্তৃপক্ষের বক্তব্য :
কারখানার পার্শবর্তী চায়ের দোকানদার আব্দুর রহমান বলেন, আগুন লাগার কিছুক্ষণের মধ্যেই ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি চলে আসে। তার কিছুক্ষণ পরেই ভবনের বিভিন্ন তলা থেকে লাফিয়ে শ্রমিকরা মাটিতে পড়তে থাকে। উৎসুক মানুষের ছিল অনেক ভিড়।
কারখানার ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) কাজী রফিকুল ইসলাম বলেন, করোনার কারণে কারখানার অধিকাংশ ইউনিট বন্ধ ছিলো। চালু ছিলো অল্প কিছু বিভাগ। ভবনের একাধিক ফ্লোর গোডাউন হিসেবে ব্যবহার করা হতো। কলাপসিবল গেইটে কে কেনইবা তালা লাগিয়েছেন তিনি তা বলতে পারেননি।
সেজান গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাহান শাহ আজাদ বলেন, এটি শুধু শ্রমিক পরিবারের নয়; পুরো সেজান গ্রুপের অপূরণীয় ক্ষতি হল।
নারায়ণগঞ্জ অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) শামীম ব্যাপারী বলেন, নিহতদের দেহাবশেষ ডিএনএ পরীক্ষা করে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হবে। ইতিমধ্যেই ময়নাতদন্তের ও ডিএনএ পরীক্ষার জন্য দেহাবশেষ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্ণেল জিল্লুর রহমান বলেন, ভবনের কলাপসিবল গেট তালাবদ্ধ থাকায় উদ্ধার কাজ ব্যহত হয়েছে। তালাবদ্ধ না থাকলে এত প্রাণহানির ঘটনা ঘটতো না।
ঘটনাস্থল পরিদর্শক করে র্যাব মহাপরিচালক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, এই অগ্নিকান্ডের ঘটনায় কারো কোনো গাফিলতি থাকলে র্যাব তা তদন্ত করে জড়িতদের আইনের আওতায় আনবে।
রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও জেপি’র শোক :
সেজান জুস কারখানায় অগ্নিকান্ডে ৫২ জন শ্রমিক নিহত হওয়ায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পৃথক এক শোক বার্তায় নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
জাতীয় পার্টি-জেপি’র চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এমপি ও দলের সাধারণ সম্পাদক সাবেক শিক্ষামন্ত্রী শেখ শহীদুল ইসলাম এক বিবৃতিতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। বিবৃতিতে নেতৃদ্বয় বলেন, অগ্নিকান্ডে নিহত হওয়ার কারণ ও সংশ্লিষ্ট কারখানায় অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা কেমন ছিল তা সুষ্ঠ তদন্তের মাধ্যমে বের করা প্রয়োজন যা পরবর্তীতে এ ধরনের ঘটনা পুনরাবৃত্তি রোধ করা যায়।
প্রকৌশল নিউজ/এমআরএস