সরকারি সেবা জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে ডিসিদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর ২৪ দফা নির্দেশনা
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বহুল প্রতীক্ষিত তিন দিনব্যাপী জেলা প্রশাসক সম্মেলন উদ্বোধনকালে দেশের সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে জেলা প্রশাসকদের ২৪ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বহুল প্রতীক্ষিত তিন দিনব্যাপী জেলা প্রশাসক সম্মেলন উদ্বোধনকালে দেশের সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে জেলা প্রশাসকদের ২৪ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘দেশ ক্রমাগত এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। আপনারা যে বিশাল কাজ গুলো করছেন তার মধ্যে কিছু সমস্যার বিষয়ে আপনাদের ফোকাস করার আহ্বান জানাই।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘দেশ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে পৌঁছে যাওয়ায় দায়িত্ব বেড়ে গেছে। ‘সরকারি সেবা নিতে সাধারণ মানুষ যেন কোনোভাবেই হয়রানি বা বঞ্চনার শিকার না হন, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ সকলে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রধান অতিথি হিসেবে ভার্চুয়ালি সম্মেলনের উদ্বোধন করেন।
প্রাণঘাতী ভাইরাস পরিস্থিতিতে দুই বছর পর ডিসি সম্মেলন আয়োজনে সক্ষম হওয়ায় তিনি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে ধন্যবাদ জানান।
কভিড-১৯ এর নতুন প্রকোপের কারণে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ১৫ জন মন্ত্রী ও সচিবের উপস্থিতিতে ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে সম্মেলন শুরু হয়েছে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস বক্তব্য রাখেন।
খুলনার বিভাগীয় কমিশনার ইসমাইল হোসেন বিভাগীয় কমিশনারদের পক্ষে এবং চাঁদপুর ও রংপুরের জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ ও আসিফ আহসান জেলা প্রশাসকদের পক্ষে বক্তব্য রাখেন।
অনুষ্ঠানে মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনের মাধ্যমে সারাদেশে সরকারের সকল উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জনগণের কল্যাণ ও কাজ নিশ্চিত করার জন্য সেবা সম্পর্কিত একটি ভিডিও প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়।
সেবার মনোভাব নিয়ে সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল থাকার আহবান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডিসিদের জন্য যে ২৪ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন। তা হচ্ছে-
(১) করোনাভাইরাস জনিত সংকট মোকাবিলায় সরকার কর্তৃক সময়ে সময়ে জারিকৃত নির্দেশনাসমূহ মাঠ পর্যায়ে প্রতিপালন নিশ্চিত করতে হবে।
(২) জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও মুজিববর্ষ উপলক্ষে গৃহীত উন্নয়ন ও সেবামূলক কার্যক্রম সমূহের যথাযথ বাস্তবায়ন এবং এর ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে হবে।
(৩) খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং বাজার মূল্য স্থিতিশীল রাখার জন্য গৃহীত বিভিন্ন কর্মসূচির বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
(৪) সরকারি অফিস সমূহে সাধারণ মানুষ যেন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বিঘেœ যথাযথ সেবা পায় সেটি নিশ্চিত করতে হবে। সেবা প্রত্যাশীদের সন্তুষ্টি অর্জনই যেন হয় সরকারি কর্মচারীদের ব্রত।
(৫) এসডিজি স্থানীয় করণের আওতায় নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রাসমূহ অর্জনে তৎপরতা জোরদার করতে হবে।
(৬) গৃহহীনদের জন্য গৃহনির্মাণ, ভূমিহীনদের কৃষি খাসজমি বন্দোবস্তসহ সকল সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে যেন প্রকৃত অসহায়, দুস্থ ও সুবিধাবঞ্চিত প্রান্তিক শ্রেণির মানুষ সুযোগ পায় তা নিশ্চিত করতে হবে।
(৭) শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের পাঠদান কার্যক্রমের মানোন্নয়নে উদ্যোগী হতে হবে। কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে বিকল্প ব্যবস্থায় অনলাইনে বা ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে পাঠদান কার্যক্রম যেন অব্যাহত থাকে সে ব্যবস্থা নিতে হবে। অপেক্ষাকৃত দুর্গম এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে।
(৮) কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রগুলো যেন কার্যকর থাকে তা প্রতিনিয়ত তত্ত্বাবধান করতে হবে এবং নানাবিধ কর্মসূচির মাধ্যমে জনগণের মাঝে স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়াতে হবে।
(৯) শিশু-কিশোরদের শারীরিক-মানসিক বিকাশের লক্ষ্যে তাদের জন্য প্রত্যেক এলাকায় সৃজনশীলতার চর্চা, সাংস্কৃতিক কর্মকা- ও ক্রীড়া সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
(১০) নাগরিকদের সুস্থ জীবনাচারের জন্য জেলা ও উপজেলায় পার্ক, খেলার মাঠ প্রভৃতির সংরক্ষণ এবং নতুন পার্ক ও খেলার মাঠ তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে।
(১১) পরিবর্তনশীল বিশ্বের সাথে সঙ্গতি রেখে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সর্বোচ্চ সুবিধা নিতে উচ্চ প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ শ্রমশক্তি গড়ে তুলতে কাজ করতে হবে।
(১২) জনসাধারণের মাঝে তথ্য প্রযুক্তি ও ইন্টারনেটের নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিতকরণে কাজ করতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহার, গুজব ইত্যাদি রোধকল্পে উদ্যোগ নিতে হবে।
(১৩) বাংলাদেশের ধর্মীয় সম্প্রীতি ও অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্যকে অক্ষুন্ন রাখার লক্ষে ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে হবে।
(১৪) মাদকমুক্ত সমাজ গঠনের লক্ষ্যে মাদকের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অব্যাহত রাখতে হবে। মাদকবিরোধী অভিযান নিয়মিত পরিচালনা করতে হবে।
(১৫) নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা, নিপীড়ন ও বৈষম্যমূলক আচরণ বন্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বাল্যবিবাহ, যৌন হয়রানি, খাদ্যে ভেজাল, নকল পণ্য তৈরি ইত্যাদি অপরাধ রোধকল্পে নিয়মিত ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করতে হবে।
(১৬) বাজারে পণ্যের সরবরাহ মসৃণ রাখতে, কৃত্রিম সংকট রোধকল্পে ও পণ্যমূল্য স্বাভাবিক রাখতে বাজার মনিটরিং কার্যক্রম জোরদার করতে হবে।
(১৭) সরকারি জমি, নদী, বনভূমি, পাহাড়, প্রাকৃতিক জলাশয় প্রভৃতি রক্ষায় কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। ভূমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিতকরণের উদ্দেশে নতুন সরকারি প্রতিষ্ঠান স্থাপনে ভবনের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণকে প্রাধান্য দিতে হবে; পরিকল্পিত নগরায়ন ও বনায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
(১৮) পর্যটন শিল্পের বিকাশ এবং রক্ষণাবেক্ষণে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। নতুন নতুন পর্যটন স্পট গড়ে তুলতে হবে।
(১৯) জেলার নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি রক্ষা এবং জেলাভিত্তিক বিখ্যাত পণ্যসমূহের প্রচার ও বিপণনে উদ্যোগী হতে হবে।
(২০) জেলার সকল সরকারি দপ্তরের কার্যক্রমসমূহ যথাযথভাবে সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ দেশের কাতারে পৌঁছাতে আপনাদের ব্রতী হতে হবে।
(২১) জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ এবং ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি অর্থাৎ সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে, উপজেলা, জেলা এবং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, পৌর মেয়র এবং অন্যান্য নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি যারা রয়েছেন তাদের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে হবে এবং উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন সমন্বয় করতে হবে। উন্নয়ন প্রকল্প যেন যত্রতত্র না হয় সেদিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে।
(২২) সমাজে অনগ্রসর শ্রেনী বেদে, জেলে, কৃষক, হিজড়া, হরিজন ও পরিচ্ছন্ন কর্মীসহ যারা একেবারেই সমাজের অনগ্রসর শ্রেনী তাদের সার্বিক উন্নয়ন, বাসস্থান এবং তাদের জন্য সবধরনের সুযোগ সুবিধা সৃষ্টি করতে হবে।
(২৩) মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন অঞ্চলে গণহত্যার শিকার পরিবারগুলোর বর্তমান অবস্থা জানা এবং তাদের যথাযথ সম্মানজনক জীবন যাত্রার ব্যবস্থা করে দিতে হবে।
(২৪) গণকবর সংরক্ষণ এবং যুদ্ধক্ষেত্র গুলো চিহ্নিত করে সে গুলো সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে এবং এর ইতিহাস জনসমক্ষে তুলে ধরতে হবে। সুত্র-বাসস।