‘সর্বাত্মক লকডাউন’; রাজু বেপারীদের ‘সব শ্যাষ’
‘আইজ সহাল নয়ডার সময় আমার বউয়ের বাইচ্চা হইছে। বহুত কষ্টে একজন ডাক্তারের বাসায় আনছিলাম। তারে দেওয়ন লাগবো বারোশ টাহা। এক টাহাও দিতে পারি নাই। কইছি কয়েকটা দিন পরে দিমু। এই দিকে নতুন বাচ্চাসহ বউডারে ঘরে একলা রাইখা রিকশা নিয়া বাইর হইছি। বউডার স্যালাইন চলতাছে। কি করমু আমি।’ এসব কথা শুনে বুকের ভেতর যেন ঢুকরে কেঁদে উঠে। কথাগুলো বলছিলেন রিকশা চালক রাজু ব্যাপারীর।
‘আইজ সহাল নয়ডার সময় আমার বউয়ের বাইচ্চা হইছে। বহুত কষ্টে একজন ডাক্তারের বাসায় আনছিলাম। তারে দেওয়ন লাগবো বারোশ টাহা। এক টাহাও দিতে পারি নাই। কইছি কয়েকটা দিন পরে দিমু। এই দিকে নতুন বাচ্চাসহ বউডারে ঘরে একলা রাইখা রিকশা নিয়া বাইর হইছি। বউডার স্যালাইন চলতাছে। কি করমু আমি।’ এসব কথা শুনে বুকের ভেতর যেন ঢুকরে কেঁদে উঠে। কথাগুলো বলছিলেন রিকশা চালক রাজু বেপারী।
রাজধানী জুড়ে দিনমজুর আর নিম্ন আয়ের মানুষের লকডাউনের এই ৫ দিনে জীবনের হাহাকারে রাজধানীর বাতাস যেন ভারী হয়ে উঠছে। একদিকে একের পর মানুষের মৃত্যু, অন্যদিকে নিম্ন আয়ের মানুষের অর্থাভাবে দিনাতিপাত।
নভেল করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ের দ্রুত সংক্রমণ বিস্তাররোধে দেশব্যাপী চলছে সরকার ঘোষিত ‘সর্বাত্মক লকডাউন’। এই লকডাউনে সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি অফিস, আর্থিক প্রতিষ্ঠান সব কিছু বন্ধ রয়েছে। তবে বিমান, সমুদ্র, নৌ ও স্থলবন্দর এবং এ-সংক্রান্ত অফিসগুলো এই নিষেধাজ্ঞার আওতার বাইরে রয়েছে। প্রথম ব্যাংক বন্ধের ঘোষণা দিলেও পরে তা আবার খোলার সিদ্ধান্ত হয়। আর শিল্পকারখানাগুলো নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চালু আছে। রয়েছে চলাচলেরও কঠোর নিষেধাজ্ঞা।
তবে এই ‘সর্বাত্মক লকডাউন’ এ সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুক্ষীণ হচ্ছেন দেশের দিনমজুর শ্রেণির মানুষেরা। যাদের নেই কোন সঞ্চয়। প্রতিদিনের উপার্জনের টাকায় চলে তাদের সংসার।
এবার আসা যাক রাজু বেপারীর প্রসঙ্গে। রাজু বেপারী, বয়স আনুমানিক ৩৫ বছর। পেশায় তিনি রিকশা চালক। ঢাকার হাজারীবাগের চরঘঘাটা এলাকায় পরিবার নিয়ে থাকেন রাজু। একই এলাকার রানা বেকারী মোড়ে তার রিকশার মহাজনের গ্যারেজ। ‘সর্বাত্মক লকডাউন’ এর পঞ্চম দিন বিকেলে রাজধানীর বাংলামটর এলাকায় কথা হয় তার সাথে। অনেক কষ্ট নিয়েই জানালেন, চলমান এই লকডাউনে তার নানা রকমের ভোগান্তির কথা।
এমনিতে স্বাভাবিক সময়ে গড়ে দিনে নুন্যতম ৫শ’ টাকা উপার্জন হলেও করোনাকালীন সময়ে চলমান এই লকডাউনে তা আর হচ্ছে না। ‘‘গত কাইল সারাদিনে মাত্র ৩০ টাহা ভাড়া মারছি। আমার রিকশার জমাই আছে ১০০ টাহা। পরে হাওলাদ (ধার) কইরা রিকশার টাহা জমা দিসি।” কিছু বলে ওঠার আগেই নিজ থেকে জানালেন তার কষ্টের কথা।
লকডাউনের এই সময়ে কেমন আছেন এমন প্রশ্নের উত্তরে রাজু বেপারী জানালেন, ‘‘অবস্থা খুবই খারাপ। সকাল থেইকা মাত্র তিনডা ক্ষ্যাপ (ভাড়া) মারছি। এহনতরি একশ টাহাও কামাইতে পারি নাই। শেষ ভাড়া মারছি তাও দুই ঘণ্টা আগে। তারপর থেইকা এইহানেই বইসা রইসি। কোন ভাড়া পাই নাই।’
রাস্তায় রিকশা নিয়ে অলস বসে থাকা রাজু বেপারীর সাথে আরও কথা এগিয়ে নিতে পারিবারিক খোজ খবর নেওয়া শুরু। জানার চেষ্টা তার জীবনের গল্প। নির্দিধায় রাজু বেপারী জানালেন, লকডাউনে নিজের ও পরিবারের জীবন যুদ্ধের দিনলিপী।
বরিশালে জন্ম নেওয়া রাজু বেপারী শৈশব থেকেই আছেন এই রাজধানীতেই। তার বাবা ছিলেন কৃষক, থাকতেন বরিশালেই। বছর খানেক আগে মারা গেছেন তিনি। রাজুর রিকশা চালক হয়ে উঠার সময়টাও বেশি দিনের নয়। মাত্র বছর খানেক। বহুবছর তিনি তার ভাইয়ের সাথে রাজধানীর হাতিরপুলে ফলের ব্যবসা করতেন। পারিবারিক কলহে সে ব্যবসা ছেড়ে রিকশার প্যাডেলে তুলে নিয়েছেন জীবনের চাকা।
‘‘রিকশা চালাইতে মেলা কষ্ট ভাই। পরথম পরথম সারা গায় ব্যাথা করতো। এহন সইয়া গেছে। গরীব মানুষ। রিকশা না চালাইলে বউ পোলাপানরে খাওয়ামু কি?” কথার প্রসঙ্গে বললেন রাজু বেপারী।
এই লকডাউনে যেখানে রিকশার প্রতিদিনের জমার টাকাই যেখানে তুলতে পারছেন না সেখানে কিভাবে সংসারের খরচ জোগাচ্ছেন এমন প্রশ্নে রাজু বললেন, ‘‘সামান্য কিছু টাহা ঘরে জমা রাখছিলাম, বিপদ-আপদের কথা ভাইবা। ওইডাই খরচ করলাম এই কয়দিনে। এহন আর কিছুই জমা নাই। সব শ্যাষ।’’
এই চলমান ‘সর্বাত্মক লকডাউন’ এ রাস্তায় রিকশা চালাতে কোন বাঁধার সম্মুক্ষীণ হয়েছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘বিকাল হইলেই পুলিশ রিকশা আটকায়। পরে রাস্তায় উপর কইরা ফালাই রাখে। দুই-তিন ঘণ্টার আগে আর ছাড়ে না। অনেক সময় চাকার হাওয়া ছাইড়া দেয়। কয়, লকডাউনের মধ্যেও এই বিকালে রাস্তায় রিকশা নিয়া বাইর হইসস কেন? জিগাতলা বাসস্ট্যান্ড, সাইন্সল্যাব মোড়, কলাবাগান সবখানেই এই সমস্যা হয়।’’ তার কথায় যেন রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে এক বুক হতাশা।
তবে রাজুর সাথে কথার শেষ দিকে তিনি জানালেন একটি সুখবরের কথা। আজ বাবা হয়েছেন তিনি। কিন্তু দেশজুড়ে করোনার ভয়াবহ সংক্রমণ ও চলমান লকডাউন পরিস্তিতি তার সেই সুখকেও যেন চোখের জলে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
আকাশের দিকে খানিকটা চেয়ে চোখের কোণায় দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ার আগেই রাজু কার যেন ডাক শুনলেন। বিড়বিড় করতে করতে রিকশার প্যাডেলে পা রেখে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা তার। কিন্তু তার এই চেষ্টা কি আদৌ তার নবজাতকের জন্য সামান্য আনন্দ বয়ে নিয়ে আনতে পারবে? সে কথা বোধহয় আমরা কেউই জানি না।