দেশের অর্থনীতিতে বিপ্লব ঘটাবে পাহাড়ের কফি ও কাজু বাদাম: কৃষিমন্ত্রী
বাদশা কুমার ত্রিপুরা খগড়াছড়ির স্থানীয় একটি সরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষক। কৃষিতে প্রবল আগ্রহ তার। দেশে নতুন ফসলের খবর পেলেই আগ্রহী হয়ে ওঠেন। আগে দুই একর পুকুরে মাছ চাষ করে মোটামুটি লাভের মুখ দেখেছেন। সরকারের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) কাছে কফি চাষের বিষয়ে জানতে পেরেছেন। আর তারপরই আট একর জমিতে কফি চারা লাগিয়েছেন। সেই কফি গাছে এবার ফুল এসেছে।
তিনি বলেন, ‘আমি পাহাড়ের যে জায়গায় কফি লাগিয়েছি সেখানে আম ও কলার বাগান ছিল। কৃষি বিভাগের সহায়তায় আমি নিয়মিত পরিচর্যায় কফি বাগানে ভালো ফলন আশা করছি।’
পানছড়ি উপজেলার মরাটিলা গ্রামের বাদশা ত্রিপুরা আরও বলেন, ‘শুরুর দিকে ৪০০-৫০০ কফি গাছ লাগালেও এখন আমার বাগানে কফি গাছের সংখ্যা প্রায় ৩ হাজার ২০০। আগাম লাগানো কফি গাছগুলোতে ফুল এসেছে, ফল পেলে বাজারে বিক্রি করতে পারবো।’
পাহাড়ি জেলা খাগড়াছড়ি, বান্দরবানসহ আশপাশের এলাকাগুলোতে চাষ হচ্ছে বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় পানীয় কফি। পাহাড়ের আবহাওয়া আর মাটি চাষের উপযোগী হওয়ায় এখন অনেকেই বাণিজ্যিকভাবে ঝুঁকছেন। জেলার বিভিন্ন উপজেলার চাষিরা অ্যারাবিকা ও রোবাস্টা জাতের কফি চাষ করে সফলতাও পাচ্ছেন।
একই জেলার স্থানীয় উন্নয়নকর্মী রুমেল মারমা সাড়ে তিন একর জমিতে কফি চাষ করেছেন। তিনি বলছেন ভালোই আবাদ হয়েছে। প্রথম দিকে প্রায় ছয়শ’ কফি চারা লাগালেও পরবর্তিতে আরও এগারোশ’ চারা লাগিয়েছেন। এখন সেইসব কফি গাছে ফুল এসেছে। তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা এক ইঞ্চি জমিও খালি রাখা যাবে না। সেই ভাবনা থেকে আমার আম বাগানে কফি গাছের চারা লাগিয়েছি। দেশে কফির চাহিদা থাকায় আমি কফি চাষে লাভবান হবো বলে আশা করছি।’
উত্তরের জেলা রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার বড়আলমপুর ইউনিয়নের চাষি মাঈনুল ইসলাম বলেন, ‘আমার ৫০ শতক ৫০ শতক করে দুটি ভিউ (জমি) আছে। এই ভিউগুলো উঁচু তাই আগে আখ চাষ করতাম। তবে এখন একটাত কফি লাগাইছি, আরেকটাত কাজু বাদাম।’
‘আমার কফি ও কাজুবাদামের ক্ষেত অনেক ভালো হইছে। এবার ফুলও আসছে। জানি না, ফল পাব কি না। তবে এখন আমার এই দুই বাগানে সাথী ফসল হিসেবে মাসকালাই ও কুল গাছও আছে’ বলেন তিনি।
বাদশা ত্রিপুরা বা রুমেল মারমা বা মাঈনুল ইসলামই নয়, সারাদেশে অনেকেই কফি চাষ করে ভাগ্য বদলানোর স্বপ্ন দেখছেন। তাদের অনেকেই জানিয়েছেন, সঠিকভাবে কফি চাষ করতে পারলে ভালো ফলন হয়, আর বিক্রি করে লাভবান হওয়া যায়। তারা আশা করছেন একদিন স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে দেশের বাইরেও কফি রপ্তানি করা সম্ভব হবে।
বান্দরবান জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) উপপরিচালক (ডিডি) এম, এম, শাহ্ নেয়াজ বলেন, ‘বান্দরবান পার্বত্য জেলা আগে থেকেই সীমিত পর্যায়ে কফি ও কাজু বাদামের আবাদ হতো। এই কফি ও কাজু বাদামটায় কৃষক ঠিকমতো পরিচর্চা করতো না। যার কারণে এর ফলের আকার খুব ছোট হয়ে আসছিল। আমরা প্রকল্পের মাধ্যমে যে কাজটি করছি, পুরনো কফি ও কাজু বাদাম বাগানগুলোর কৃষকদের ট্রেনিং দিয়ে পরিচর্চার আওতায় নিয়ে আসছি। আর নতুন করে ব্যাপক এলাকায় কফি ও কাজু বাদাম চাষ করতে কৃষকদের উৎসাহিত করছি।’
রংপুর জেলার ডিএই-এর উপপরিচালক (ডিডি) মো. ওবায়দুর রহমান মণ্ডল বলেন, ‘আমরা এই জেলার দুটি উপজেলায় কফি ও কাজুবাদাম চাষে কৃষকদের চারা, প্রশিক্ষণ ও বিভিন্ন সহায়তা দিয়েছি। সরকারি এ উদ্যোগ সফলভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হলে কফি ও কাজুবাদাম চাষ করে এ অঞ্চলের কৃষকরা নিজেদের আর্থিক উন্নয়ন ঘটাতে পারবেন বলে আশা করছি।’
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশে কাজুবাদামের উৎপাদন ২০১৯ সালে ৯৭২ মেট্রিক টন, ২০২০ সালে ১৩৮২ মেট্রিক টন, ২০২১ সালে ১৫৬২ মেট্রিক টন, ২০২২ সালে ১৮৪২ মেট্রিক টন। অন্যদিকে কফির উৎপাদন ২০২০ সালে ৫৫ দশমিক ৭২ মেট্রিক টন, ২০২১ সালে ৫৮ মেট্রিক টন, ২০২২ সালে ৬২ মেট্রিক টন। আর কাজুবাদাম আমদানি করা হয়েছে, ২০১৮ সালে ৩৩০ মেট্রিক টন, ২০১৯ সালে ৫১০ মেট্রিক টন, ২০২০ সালে ১৬২৪ দশমিক ৭৭ মেট্রিক টন, ২০২১ সালে ২০৩০ দশমিক ৫৬ মেট্রিক টন, ২০২২ সালে ৪৩১ দশমিক ৭৮ মেট্রিক টন। কফি আমদানি ২০১৮ সালে ৮৫৫ মেট্রিক টন।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে ৩ হাজার একশ ২টি কাজুবাদাম জাত ও প্রযুক্তি প্রর্দশনী, দুই হাজার ৭৪৪টি কফি জাত ও প্রযুক্তি প্রর্দশনী দেয়া হয়েছে। এছাড়া, আড়াইশ’ একর জমিতে ২২২টি কাজুবাদামের বাণিজ্যিক প্রদর্শনী, ১৬৪টি কফি চাষের বাণিজ্যিক প্রদর্শনী শেষ হয়েছে। চলতি বছরের জুনের মধ্যে প্রকল্পের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে।
বিশ্বব্যাপী কাজুবাদাম ও কফির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে উল্লেখ করে কাজুবাদাম ও কফি গবেষণা উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের দেশেও এর বাজার বাড়ছে। দেশের পাহাড়ি এলাকায় কাজুবাদাম ও কফি চাযের ব্যাপক সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর লক্ষ্য কৃষিমন্ত্রীর দিকনির্দেশনায় প্রকল্পের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রকল্পের আওতায় ইতোমধ্যে ১২ লাখ কাদুবাদাম ও কফির চারাসহ অন্য উপকরণ বিতরণ করা হয়েছে। নতুন করে বর্তমান মৌসুমে আরও ১০ লাখ চারা বিতরণ করা হবে। বাগান স্থাপনে প্রকল্প থেকে সব ধরনের সহায়তা করা হচ্ছে। প্রকল্পের আওতায় নতুন নতুন উদ্যোক্তার সৃষ্টি হচ্ছে।’
সমতলের চেয়ে পাহাড়ি অঞ্চলে এর ব্যাপক চাষ হচ্ছে বলে জানান তিনি। ‘দাম ও চাহিদা দুটোই বৃদ্ধি পাওয়ায় পাহাড়ি এলাকার চাষিদের মাঝে এ দুটি ফসল চাষে ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে।’
কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘কফি ও কাজু দুইটাই অর্থকারী ফসল এবং বাংলাদেশের আবহাওয়া জলবায়ু দুটি ফসল করার ক্ষেত্রে বেশ অনুকূল। বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম, মধুপুরের বনাঞ্চল এবং বরেন্দ্র এলাকায়ও হবে। ফসলগুলো বাংলাদেশের জন্য একটা সম্ভবনাময় ফসল এবং আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানির যথেষ্ট সুযোগ আছে।’
‘একসময় ভিয়েতনামে ফসল দুটি কোন গুরুত্বপূর্ণ ফসল ছিল না। কিন্ত এখন পৃথিবীতে নেতৃস্থানীয় রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে ৪ বিলিয়ন ডলার কেশোনাট ও কফি থেকে আয় করে। তারা বিদেশ থেকে কেশোনাট ও কফির নাট নিয়ে এসে ভ্যালু এডিশন করে ভালো আয় করছে। কাজেই এই দুই ফসলেরই রপ্তানির বিরাট সুযোগ আছে।’
চলমান প্রকল্প সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমরা চাষিকে বিনামূল্যে চারা দিচ্ছি। তাদের উৎসাহিত করছি। প্রযুক্তি দিচ্ছি, প্রশিক্ষণ দিচ্ছি, মোটিভেশন করছি।’
গত বুধবার বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে একটি কাজু বাদাম ও কফি বাগান পরিদর্শনকালে কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কফি ও কাজু বাদাম বিপ্লব ঘটাবে। দেশে ও আন্তর্জাতিক বাজারে কাজু বাদাম ও কফির বিশাল চাহিদা রয়েছে, দামও অনেক বেশি। সে জন্য, এসব ফসলের চাষাবাদ ও প্রক্রিয়াজাত বাড়াতে হবে। পাহাড়ের বৃহৎ এলাকাজুড়ে এসব ফসল চাষের সম্ভাবনা অনেক।’
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, দেশে কফি ও কাজুবাদামের বাজার ‘প্রায় দেড় হাজার’ কোটি টাকার। প্রকল্পের সঠিক বাস্তবায়ন হলে কাজুবাদামের উৎপাদন ২ হাজার মেট্রিক টন থেকে ২০ হাজার মেট্রিক টনে উন্নীত করা সম্ভব। আর কফি (কফি বিন) উৎপাদন ৮ হাজার মেট্রিক টনে গিয়ে দাঁড়াবে।