বধ্যভূমিই যেন কাজলের বাবার কবর

বধ্যভূমিই যেন কাজলের বাবার কবর

বাবার সঙ্গে দেখা নেই ৪৯ বছর। বাবার মুখটা কেমন ছিল তাও মনে নেই তার। খুব মনে পড়ে বাবার কথা। কিন্তু দেখার সাধ্য নাই। রায়েরবাজার স্মৃতিসৌধে মাঝেমধ্যে এসে বাবাকে খোঁজেন। যেন বধ্যভূমির ইটের বাঁধনে বাবার আদর লুকিয়ে আছে। কথাগুলো বলতে বলতে চোখ ভিজে আসে কাজল হোসেনের।

অবসরে তর্জনীর ডগা দিয়ে চোখের কোণ মুছে জানান, একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পাকিস্তানিদের নারকীয়তায় হারিয়ে যাওয়া বাবার কথা। বিজয় দিবসের মাত্র এক দিন আগে, ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর, বাবাকে হারান কাজল। পাকিস্তানিরা ধরে নিয়ে যায় তার বাবা আমির চান হোসেনকে। আর ফিরে আসেননি তিনি। এমনকি পাওয়া যায়নি বাবার মরদেহ। তখন খোঁজ-খবর নিয়ে কাজলরা জানতে পারেন, রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে নিয়ে বেশ কজনকে একসঙ্গে ব্রাশফায়ারের মাধ্যমে হত্যা করেছিল পাকিস্তানিরা। তাদের একজন কাজলের বাবা আমির চান।

সেদিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন কাজল। বলেন, ‘তখন আমার বয়স আট থেকে নয় বছর। সব বুঝি। সব জায়গা থেকে খবর আসছিল, পাকিস্তানিরা হেরে গেছে। বাংলাদেশ স্বাধীন। আমরাও অনেকটা নিশ্চিন্তে ছিলাম তখন।’ ‘দেশ স্বাধীন হওয়ার আগের দিনের কথা। বাবা গোসল করতে গেল। সাত মসজিদের (সাত গম্বুজ মসজিদ) পেছনে তখন ঘাট ছিল। সবাই ওই জায়গায় গোসল করত। বাবা গেছিল দুপুরে। কিন্তু দুপুর পেরিয়ে বিকেল হয়ে যায়, বাবা আসে না। বড়রা সবাই খুঁজতে গেল, পায় না। যে লুঙ্গি নিয়ে বাবা গোসল করতে গিয়েছিল, সেটা ঘাটেই পড়ে ছিল।‘

আমিরের এক চাচা লাল চান সরকারি অফিসের সহকারী (পিয়ন) ছিলেন, আরেক চাচা কালু চান ছিলেন ইউপি মেম্বার। স্থানীয়ভাবে তাদের ভালো জানাশোনা ছিল। মোহাম্মদপুর ও আশপাশের এলাকায় পাকিস্তানি যত ক্যাম্প ছিল, সবগুলোতেই খোঁজাখুঁজি করা হয়। কিন্তু আমির চানকে কোথায় পাওয়া যায়নি। কাজলের ভাষায়, ‘পরে জানা গেল, ওই ঘাটে গোসল করতে পাঁচ-ছয়জন গিয়েছিল। তাদের সবাইকে ঘাট থেকে ধরে নিয়ে যায়। ঘাট থেকে সোজা বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের ওখানে নিয়ে যায়। তারপর সবাইকে একসঙ্গে ব্রাশফায়ার করে।

’ ‘এই খবর পাওয়ার পর আমার দাদারাও সেখানে যান। অনেক লাশ ছিল। এত লাশের মধ্যে বাবার লাশ খুঁজে পায় নাই।’ তিন ভাই, ছয় বোনের মধ্যে আমির চান ছিলেন সবার বড়। যুবক আমিরের বয়স তখন ত্রিশের ঘরে। এক সন্তানের বাবা আমির একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রাণ হারানো ত্রিশ লাখ শহীদের একজন। স্থানীয় প্রবীণদের অনেকেই এই ঘটনা জানেন। এক মেয়ে, দুই ছেলের জনক কাজল মিয়ার বয়স প্রায় ষাটের ঘরে। ঘটনার ৪৮ বছর পরেও বাবার কথা মনে পড়ে তার। কাজল বলেন, ‘অনেক ছোট ছিলাম। বাবার চেহারাটা এখন মনে নাই। অনেক চেষ্টা করি চেহারাটা মনে করার। পারি না। একবার দেখতে মনে চায়।’ যখন অবসর থাকেন কাজল, তখন রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে গিয়ে বসে থাকেন। খোঁজেন বাবার স্নেহের পরশ। যেন বধ্যভূমির ইটের ভাঁজ আর বাঁধনে বাবার আদর লুকিয়ে আছে।