কাবার চারপাশের মেঝের মার্বেল কেন গরম হয় না!
মাসজিদুল হারামের মেঝে তাওয়াফকারীদের জন্য এমন মার্বেল দিয়ে আচ্ছাদিত করে দিতে, যার বিশেষ তাপ শোষণ ক্ষমতা রয়েছে। এই বিশেষ ধরনের মার্বেল সহজলভ্য ছিল না। এই ধরনের মার্বেল ছিল পুরো পৃথিবীতে কেবলমাত্র গ্রিসের ছোট্ট একটি পাহাড়ে।
হজ্জ কিংবা উমরাহ করতে যাঁরা মক্কার হারাম শরীফে গেছেন, তাঁরা সবাই নিশ্চয়ই একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছেন- চামড়া পোড়ানো প্রখর রোদে খোলা আকাশের নিচে কাবার চারপাশে তাওয়াফ করার সময় পায়ের নিচটুকু পুড়ে যায় না, বরং বেশ শীতল একটা অনুভূত হয়। কারণ এর নেপথ্যে রয়েছে এক চমকপ্রদ ইতিহাস।
ইসলামী আর্কিটেকচারের ওপর তিনটি ডক্টরেট ডিগ্রিপ্রাপ্ত প্রথম মিশরীয় প্রকৌশলী ও স্থপতি ড. মোহাম্মাদ কামাল ইসমাইল (১৯০৮-২০০৮)। তিনিই প্রথম প্রকৌশলী যে কি না হারামাইন (মক্কা-মদিনা) সম্প্রসারণ প্রকল্পের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন।
এই সুবিশাল কর্মযজ্ঞ তত্ত্বাবধান করার জন্য সৌদি বাদশাহ ফাহাদ এবং বিন লাদেন গ্রুপের সুপারিশ থাকা সত্ত্বেও তিনি কোনো পারিশ্রমিক গ্রহণ করেননি। বরং মোটা অংকের চেক উনি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর সততা ও কাজের প্রতি আন্তরিকতা তাঁকে বাদশাহ ফাহাদ, বাদশাহ আব্দুল্লাহসহ সকলের প্রিয়পাত্র ও বিশেষ আস্থাভাজন করে তোলে।
তিনি বাকার বিন লাদেনকে বলেছিলেন, “এই দু’টি পবিত্র মসজিদের কাজের জন্য পারিশ্রমিক নিলে শেষ বিচারের দিনে আমি কোন মুখে আল্লাহর সামনে গিয়ে দাঁড়াবো?
তিনি তাঁর জীবদ্দশার পুরোটা সময় মক্কা ও মদীনার দুই মসজিদের সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন।
এবার আসা যাক মূল প্রসঙ্গে। মক্কার মাসজিদুল হারাম ও মদিনার মাসজিদুল নববীর মার্বেলের কাজের সঙ্গে ড. মোহাম্মাদ কামাল ইসমাইলের জীবনের একটি বিস্ময়কর ঘটনা রয়েছে। তিনি চেয়েছিলেন- মাসজিদুল হারামের মেঝে তাওয়াফকারীদের জন্য এমন মার্বেল দিয়ে আচ্ছাদিত করে দিতে, যার বিশেষ তাপ শোষণ ক্ষমতা রয়েছে। এই বিশেষ ধরনের মার্বেল সহজলভ্য ছিল না। এই ধরনের মার্বেল ছিল পুরো পৃথিবীতে কেবলমাত্র গ্রিসের ছোট্ট একটি পাহাড়ে।
ড. মোহাম্মাদ কামাল ইসমাইল গ্রিসে গিয়ে সেই ছোট্ট পাহাড় থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে মার্বেল কেনার চুক্তিস্বাক্ষর করে মক্কায় ফিরে এলেন এবং সাদা মার্বেলের মজুদও চলে এলো। যথাসময়ে বিশেষ নকশায় মাসজিদুল হারামের মেঝের সাদা মার্বেলের কাজ সম্পন্ন হলো।
এর ঠিক ১৫ বছর পরে সৌদি সরকার তাঁকে মাসজিদুল নববীর চারদিকের চত্বরও একইভাবে সাদা মার্বেল দিয়ে ঢেকে দেওয়ার প্রস্তাব দিলে তিনি দিশেহারা বোধ করলেন। কেননা ওই বিশেষ ধরনের মার্বেল কেবলমাত্র গ্রিসের ওই ছোট্ট পাহাড় ছাড়া গোটা পৃথিবীর আর কোথাও পাওয়া যায় না এবং সেখানে যতটুকু ছিল, তার অর্ধেক ইতিমধ্যেই কিনে মক্কার হারাম শরীফের কাজে লাগানো হয়ে গেছে। যেটুকু মার্বেল অবশিষ্ট ছিল- সেটা মাসজিদুল নববীর প্রশস্ত চত্বরের তুলনায় খুবই সামান্য!
ড. মোহাম্মাদ কামাল ইসমাইল তবুও আবার গ্রিসে গেলেন। সেই কোম্পানির সি.ই.ও-র সঙ্গে দেখা করে জানতে চাইলেন, ওই পাহাড় আর কতটুকু অবশিষ্ট আছে। গ্রীসের ঐ কোম্পানির সি.ই.ও জানালেন, ১৫ বছর আগে উনি কেনার পরপরই পাহাড়ের বাকি অংশটুকুও বিক্রি হয়ে যায়। এই কথা শুনে তিনি এতটাই বিমর্ষ হলেন যে, তাঁর আপ্যায়নে দেয়া কফি পর্যন্ত শেষ করতে পারলেন না। সিদ্ধান্ত নিলেন, পরের ফ্লাইটেই মক্কায় ফিরে যাবেন। অফিস ছেড়ে বেরিয়ে আসার আগে কী মনে করে যেন অফিস সেক্রেটারির কাছে গিয়ে সেই ক্রেতার নাম-ঠিকানা জানতে চাইলেন- যিনি বাকি মার্বেল কিনেছিলেন।
যদিও এটা অনেক দুরূহ কাজ, তবু কামালের বারবার অনুরোধে সে পুরোনো রেকর্ড চেক করে জানাবে বলে কথা দিলেন। নিজের নাম এবং ফোন নম্বর রেখে বেরিয়ে আসার সময় কামাল মনে মনে ভাবলেন- কে কিনেছে, ১৫ বছর পরে তা জেনেই-বা আর লাভ কী?
পরদিন এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার আগে সেই কোম্পানির অফিস সেক্রেটারি ফোনে জানাল, ক্রেতার নাম-ঠিকানা খুঁজে পাওয়া গেছে! কামাল ধীর গতিতে কোম্পানির দিকে যেতে যেতে ভাবলেন- ঠিকানা পেয়েই-বা লাভ কী? মাঝে তো অনেকগুলো বছর পেরিয়ে গেছে।
অফিসে পৌঁছলে সেক্রেটারি তাঁকে ওই ক্রেতার নাম-ঠিকানা দিলেন। ঠিকানা হাতে নিয়ে ড. মোহাম্মাদ কামাল ইসমাইলের হৃদ্স্পন্দন বেড়ে গেল, যখন তিনি দেখলেন- বাকি মার্বেলের ক্রেতা একটি সৌদি কোম্পানি।
কামাল সেদিনই সৌদি আরব ফিরে গেলেন। সেখানে পৌঁছে তিনি ঐ কোম্পানির ডিরেক্টর এডমিনের সঙ্গে দেখা করে জানতে চাইলেন- মার্বেলগুলো দিয়ে তাঁরা কী করেছেন, যা অনেক বছর আগে গ্রিস থেকে কিনেছিলেন?
ডিরেক্টর এডমিন প্রথমে কিছুই মনে করতে পারলেন না। কোম্পানির স্টক রুমে যোগাযোগ করে জানতে চাইলেন- ১৫ বছর আগে গ্রিস থেকে আনা সাদা মার্বেলগুলো দিয়ে কী করা হয়েছিল? তারা খোঁজ করে জানাল- সেই সাদা মার্বেল পুরোটাই স্টকে পড়ে আছে, কোথাও ব্যবহার করা হয়নি!
এই কথা শুনে কামাল শিশুর মতো ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলেন। কান্নার কারণ জানতে চাইলে তিনি পুরো ঘটনা কোম্পানির মালিককে খুলে বললেন। ড. কামাল ওই কোম্পানিকে সৌদি সরকারের পক্ষে একটি ব্ল্যাংক চেক দিয়ে ইচ্ছে মতো অংক বসিয়ে নিতে বললেন। কিন্তু কোম্পানির মালিক যখন জানতে পারলেন- এই সাদা মার্বেল রাসূল (সা.)-এর ইমামতি করার মসজিদ চত্বর বাঁধানোর জন্য ব্যবহৃত হবে, তৎক্ষণাৎ তিনি এর বিনিময় মূল্য নিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বললেন, “আল্লাহ্ সুবহানাতায়ালা আমাকে দিয়ে এটা কিনিয়েছিলেন আবার তিনিই আমাকে এর কথা ভুলিয়ে দিয়েছেন; কেননা এই মার্বেল রাসূল (সা.)-এর মসজিদের উদ্দেশ্যেই এসেছে…”
পরিশেষে এটাই বলা যায়, আল্লাহর ঘর তাওয়াফ করা সবার ভাগ্যে জুটে না। আর যার ভাগ্যে আছে সে যে কোনো উপায়ে পবিত্র মক্কা নগরীতে পৌছে যাবেই। গত বছর বিশ্বজুড়ে করোনা পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার পর বাংলাদেশের পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী মুসলিমদের পবিত্র এই মসজিদ এবং কাবা চত্ত্বরে যাওয়া হয়নি। এবছরই একই অবস্থা। নিশ্চয় আল্লাহ করোনামুক্ত পৃথিবীতে আবারো মুসলিম উম্মাহর জন্য ফরজ এই দায়িত্ব পালনের ইচ্ছা পূরণ করবেন। আমিন।