মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অভ্যুত্থানের নেপথ্যে কারা?
মিয়ানমারে অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এক বছরের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে দেশটির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে সেনাবাহিনী। অং সান সু চিসহ অন্যান্য জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক নেতাদের বন্দি করে রাখা হয়েছে। দেশটির বর্তমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠেছে, কেন এখনই অভ্যুত্থান ঘটাল সেনাবাহিনী?
মিয়ানমারে অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এক বছরের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে দেশটির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে সেনাবাহিনী। অং সান সু চিসহ অন্যান্য জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক নেতাদের বন্দি করে রাখা হয়েছে। দেশটির বর্তমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠেছে, কেন এখনই অভ্যুত্থান ঘটাল সেনাবাহিনী? মিয়ানমারের অভ্যন্তরে কী ঘটছে? সু চির জন্য এই অভ্যুত্থান কী? এরপর কী হবে?, এক প্রতিবেদনে এসব প্রশ্নের উত্তর তুলে ধরেছে বার্তাসংস্থা এপি।
এখন কেন?
গত নভেম্বরের নির্বাচনে সেনাবাহিনী সমর্থিত দলটির বিপরীতে বিপুল ব্যবধানে জয়ী হয় সু চির দল এনএলডি। সেনাবাহিনী সেই নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ তুললেও তা প্রত্যাখ্যান করে মিয়ানমারের নির্বাচন কমিশন। সদ্য নির্বাচিত সু চি সরকারের প্রথম সংসদীয় অধিবেশন গতকাল সোমবার হওয়ার কথা ছিল।
কিন্তু, এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে যথাযথভাবে সাড়া দিতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে মিয়ানমারের নির্বাচিত সরকারকে সরিয়ে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা নেওয়ার কথা সেনাবাহিনী পরিচালিত মায়াওয়াদ্দি টিভিতে ঘোষণা দেওয়া হয়। ঘোষণায় করোনা পরিস্থিতিতেও সরকার কর্তৃক নির্বাচন স্থগিত করতে ব্যর্থ হওয়ার কথাও বলা হয়।
সামরিক বাহিনী বলছে, তারা ন্যায়সঙ্গতভাবেই ক্ষমতা নিয়েছে। জরুরি পরিস্থিতিতে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা নিতে পারবে বলে সংবিধানে উল্লেখ রয়েছে। তবে, সু চির দলের মুখপাত্র ও বহিরাগত অনেকেই বলছেন, কার্যত এটি ছিল অভ্যুত্থান।
কয়েকজন বিশেষজ্ঞ হতাশা ব্যক্ত করে বলছেন, সামরিক বাহিনী দেশের স্থিতিশীল অবস্থা বিপর্যস্ত করতে চলেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মিয়ানমার গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। আর এর মধ্যেই জেনারেলরা তাদের অবিচ্ছিন্ন ক্ষমতা ধরে রেখেছেন।
আবার অনেকে বলেছেন, অভ্যুত্থানের পেছনের কারণ হলো, সামনেই সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইংয়ের অবসরে যাওয়ার কথা। ২০১১ সাল থেকেই তিনি মিয়ানমারের সেনাপ্রধান এবং তিনিই গতকাল সামরিক শাসক হিসেবে মিয়ানমারের ক্ষমতা নেন।
মিয়ানমারের বেসামরিক ও সামরিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ কিম জলিফি এপিকে বলেন, ‘এর পেছনে সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরীণ রাজনীতি রয়েছে, যা অত্যন্ত অস্বচ্ছ। এই পদক্ষেপ হয়তো সেই রাজনীতির গতিশীলতারই প্রতিচ্ছবি এবং অভ্যন্তরীণ অভ্যুত্থানই সামরিক বাহিনীর মধ্যে ক্ষমতা বজায় রাখায় উপায় হতে পারে।’
মিয়ানমারের অভ্যন্তরে কী ঘটছে?
মিয়ানমারে টেলিভিশন সিগন্যাল বন্ধ রয়েছে এবং রাজধানী নেপিডোতে ফোন ও ইন্টারনেট সুবিধা বন্ধ। বন্ধ রয়েছে যাত্রীবাহী ফ্লাইট চলাচলও। দেশের আরও অনেক জায়গাতেই টেলিফোন সেবা পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানা গেছে। যদিও, কিছু কিছু এলাকার মানুষ ধীর গতিতে হলেও ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারছেন।
সবচেয়ে বৃহৎ শহর ইয়াঙ্গুনের রাস্তায় কাঁটাতার দিয়ে ব্যারিকেড দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে সিটি হলসহ সরকারি ভবনগুলোতে সামরিক বাহিনীর সৈন্যরা অবস্থান করছেন।
স্থানীয়রা এটিএম ও খাবারের দোকানে ভিড় করছেন। সু চির দল এনএলডির প্রতীক বহন করা বেশকিছু দোকান ও ঘরবাড়ি থেকে সেই প্রতীক সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
সু চির জন্য এই অভ্যুত্থান কী?
মিয়ানমারে গণতন্ত্র পুনস্থাপনে দীর্ঘ সময় গৃহবন্দি ছিলেন অং সান সু চি। গৃহবন্দি থাকাকালীনই তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। তবে, রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো নিপীড়নের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার কারণে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার ভাবমূর্তিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো নিপীড়নকে যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কয়েকটি দেশ গণহত্যা বলে অভিহিত করেছে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিরক্ষা ইস্যুতে সু চির নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্নও তুলেছেন সাবেক মার্কিন কূটনীতিক বিল রিচার্ডসন।
এক বিবৃতিতে রিচার্ডসন বলেন, ‘মিয়ানমারের ডি-ফ্যাক্টো নেত্রী হিসেবে গণতন্ত্রের মূল্যবোধের প্রচারে সু চির ব্যর্থ হওয়ার কারণে তার উচিত ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়া এবং অন্য কোনো গণতান্ত্রিক নেতাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা, যারা আন্তর্জাতিক সমর্থন নিয়ে গণতান্ত্রিকভাবে দেশকে এগিয়ে নেবে।’
এরপর কী হবে?
মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থানের নিন্দা জানিয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো। ওয়াচডগ সংস্থাগুলো ধারণা করছে, দেশটিতে মানবাধিকারকর্মী ও গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর নিপীড়নমূলক কার্যক্রম চালানো হতে পারে। যদিও সেনাবাহিনী ক্ষমতা নেওয়ার আগেও তাদের সমালোচনাকারীদের আইনি পদক্ষেপের মুখোমুখি হতে হতো।
মিয়ানমারের এই অভ্যুত্থান আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্যেও একটি পরীক্ষা। কারণ, অতীতে দেশটিতে সামরিক শাসনব্যবস্থা থাকাকালীন তারা মিয়ানমারকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল। পরবর্তীতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মিয়ানমারে যখন গণতন্ত্রের উত্তরণ ঘটে, তখন তারা এগিয়ে আসে।
ইতোমধ্যে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে অবিলম্বে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার ও আটক নেতাকর্মীদের মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। অন্যথায় জো বাইডেন মিয়ানমারের সেনা কর্মকর্তাদের ওপর নতুন করে অবরোধের হুমকি দিয়েছেন। তিনি সেনাদের ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করতে একত্রিতভাবে আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টির আহ্বানও জানিয়েছেন।
সিনেটের ডেমোক্রেট নেতা বব মেনেনদেজ বলেছেন, ‘যাদের আটক করা হয়েছে অবিলম্বে তাদের ছেড়ে দেওয়া উচিত সামরিক নেতাদের। একইসঙ্গে তাদের উচিত ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ানো। অন্যথায় যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশের উচিত মিয়ানমারের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দেওয়াসহ সামরিক নেতাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া।’
সূত্র: ডেইলী স্টার