দেশের সমবায়ের অগ্রপথি ফাদার চার্লস জে ইয়াং
এক সময় ঢাকা শহরের দরিদ্র খ্রিষ্টভক্তরা কাবুলিওয়ালাদের নিকট হতে চড়া সুদে ঋণ নিতেন। কাবুলিওয়াদের উৎপীড়নের থাবা থেকে মুক্তি দিতে এগিয়ে এসেছিলেন তৎকালীন ঢাকার আর্চবিশপ লরেন্স এল গ্রেনার। তিনি ভাবতে থাকেন কীভাবে সাধারণ মানুষকে অর্থনৈতিক মুক্তি দেওয়া যায়।
এক সময় ঢাকা শহরের দরিদ্র খ্রিষ্টভক্তরা কাবুলিওয়ালাদের নিকট হতে চড়া সুদে ঋণ নিতেন। কাবুলিওয়াদের উৎপীড়নের থাবা থেকে মুক্তি দিতে এগিয়ে এসেছিলেন তৎকালীন ঢাকার আর্চবিশপ লরেন্স এল গ্রেনার। তিনি ভাবতে থাকেন কীভাবে সাধারণ মানুষকে অর্থনৈতিক মুক্তি দেওয়া যায়।
তিনি জানতে পারেন সমবায়ের কথা। তিনি এই সময় ফাদার চার্লস জে ইয়াং সিএসসিকে কানাডার কোডি ইনষ্টিটিউটে প্রেরণ করে সমবায়ের ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণের সুযোগ করে দেন। সমবায়ের ওপর প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করে ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে ৩ জুলাই ফাদার চার্লস জে ইয়াং প্রতিষ্ঠা করেন দি খ্রীষ্টান কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন লি:, ঢাকা (ঢাকা ক্রেডিট)।
এই সমবায় সমিতির প্রথম সদস্য ছিল ৫০ জন এবং মূলধন ছির ২৫ টাকা। ক্রমে এই সমিতির সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। দীর্ঘ ৬৬ বছর পথ পাড়ি দিয়ে এই সমিতির কলেবর বাড়তে থাকে। বর্তমানে ঢাকা ক্রেডিটের রয়েছে ৮৬টি প্রোডাক্ট ও প্রকল্প। বর্তমানে ৫৭ হাজার সঞ্চয়ী সদস্য প্রতি মাসেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিমাণে সঞ্চয় জমা করছেন, যার পরিমাণ প্রায় সাত শত কোটি টাকা।
সঞ্জিত অর্থে সদস্যরা বাসস্থান, জমি ক্রয়, চিকিৎসা ও সামাজিক কাজের মতো গুরুত্বপূর্ণ কার্য সম্পাদন করেন। সদস্যদের সঞ্চয়ী হিসেবে গড়ে তোলার নিমিত্তে রয়েছে সাধারণ সেভিংস, দীর্ঘমেয়াদি আমানত সুবিধা, মাসভিত্তিক সঞ্চয়, মিলিনিয়ার স্কীম, শিশু-কিশোরদের জন্য বী-সেভার্স ও স্মার্ট-সেভার্স, বিবাহ সঞ্চয় স্কীম, ডাবল ডিপোজিট স্কীম, অবসর জীবনের নিরাপত্তার জন্য বয়ষ্ক সঞ্চয় প্রকল্প ইত্যাদি। সর্বশেষ চালু করা হয়েছে পেনশন বেনিফিট স্কীম। এই প্রকল্পের মধ্য দিয়ে একজন সদস্য কর্মক্ষম সময় টাকা সঞ্চয় করতে পারবেন এবং তিনি যখন অবসরে যাবেন, তখন সেই সঞ্চিত টাকা থেকে পেনশনের টাকা পেয়ে মর্যাদাশীল জীবন যাপন করতে পারবেন।
সঞ্চয়ের পাশাপাশি সদস্যরা আমানত জমা করে সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে উৎপাদনশীল খাতে ব্যবহার করছেন। অনেকে নিজের ব্যবসায় বিনিয়োগ করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছেন। এক হাজারের অধিক শিক্ষার্থী এই সমিতি থেকে উচ্চশিক্ষা, উচ্চশিক্ষা সাপোর্ট এবং প্রফেশনাল ট্রেইনিং ঋণ গ্রহণ করে দেশ-বিদেশে উন্নত জীবন যাপন করছেন। ১১শ এর অধিক সদস্য ঋণ নিয়ে নির্মাণ করেছেন তাঁদের নিরাপদ বাসস্থানের ব্যবস্থা। সদস্যদের ভবিষ্যত অর্থনৈতিক বুনিয়াদ মজবুদ করণের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠান বর্তমানে সর্বোচ্চ ১০ কোটি টাকা ঋণ প্রদান করে থাকে। সঞ্চয় ও ঋণ সেবার পাশাপাশি এই প্রতিষ্ঠানের রয়েছে সামাজিক দায়বদ্ধতা। তার মধ্যে রয়েছে সিংগাপুর থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষিকা দ্বারা পরিচালিত আন্তর্জাতিকমানের ডিসি চাইল্ড কেয়ার অ্যান্ড এডুকেশন সেন্টার, কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও কর্মীজীবী নারীদের জন্য তিনটি ছাত্রী হোস্টেল, ডিসি সিকিউরিটি সার্ভিস, শরীরচর্চার জন্য জীম, সমবায় বাজার ইত্যাদি।
ঢাকা ক্রেডিটের উল্লেখযোগ্য প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে ৩০০ শয্যাবিশিষ্ট নির্মিয়মান ডিভাইনমার্সি জেনারেল হাসপাতাল। এখানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে স্বল্প খরচে উন্নতমাসের চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হবে।
দীর্ঘ পথ চলায় ঢাকা ক্রেডিট ও এর নেতৃবৃন্দ পেয়েছেন স্বীকৃতি। যার ফলে ১৯৯০, ১৯৯৪, ১৯৯৫, ১৯৯৭ ও ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা ক্রেডিট শ্রেষ্ঠ ক্রেডিট ইউনিয়ন হিসেবে জাতীয় স্বর্ণপদক লাভ করে এবং শ্রেষ্ঠ সমবায়ী হিসেবে সমিতির চারজন প্রেসিডেন্ট পর্যায়ক্রমে প্রয়াত হিউবার্ট গমেজ, প্রয়াত ডানিয়েল কোড়াইয়া ও প্রয়াত অরুণ বার্নার্ড ডি’কস্তা ও বাবু মার্কুজ গমেজ জাতীয় স্বর্ণপদক লাভ করেন।
আর একটি বড় সফলতা হলো ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা ক্রেডিটের শিক্ষা তহবিলের অর্থ ব্যবহার করে সমবায় আন্দোলন বিস্তৃত করার লক্ষে ঢাকা ক্রেডিট দি কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন লীগ অব বাংলাদেশ লিমিটেড (কাল্ব) প্রতিষ্ঠা করে। এ ছাড়াও বর্তমানে সফলভাবে খ্রিষ্টান সমিতিরগুলোর অভিভাবক হয়ে ওঠা দি সেন্ট্রাল এসোসিয়েশন অব খ্রীষ্টান কো-অপারেটিভ লি: (কাক্কো)-এর প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ঢাকা ক্রেডিটের ভূমিকা অবিস্মরণীয়।
ফাদার চার্লস জে ইয়াং শুধু ঢাকা ক্রেডিট প্রতিষ্ঠা করে বসে থাকেননি। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন মানুষের অর্থনৈতিক দুদর্শা দূর করতে প্রয়োজন সমবায়। তাই তিনি ঢাকার নবাবগঞ্জ, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, এমনকি পাবনা ও নাটোরেও গিয়েও সমবায়ের গুরুত্ব তুলে ধরেন। তিনি খ্রিষ্টান ধর্মীয় নেতা, সমাজ নেতা ও শিক্ষকদের সমবায়ের সাথে জড়িত করেন। বর্তমানে দেশে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের দ্বারা পরিচালিত কমপক্ষে সাড়ে তিন শত সমবায় সমিতি রয়েছে যার সম্পাদ পরিসম্পদ কমপক্ষে পাঁচ হাজার কোটি টাকা এবং এই সব সমবায় সমিতিগুলোতে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ২০০০ লোকের।
ফাদার চার্লসের মূল্যবোধ সকল মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে এবং তাঁর স্বপ্ন ও স্মৃতিকে অবিস্মরণীয় করে রাখার লক্ষ্যে ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে ১৪ নভেম্বর ঢাকা ক্রেডিটের প্রতিষ্ঠাতা ফাদার চার্লস জে. ইয়াং-এর নামানুসারে ফাদার চার্লস জে. ইয়াং ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এই ফাউন্ডেশন নিবন্ধক লাভ করে ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের ৭ ডিসেম্বর।
এই ফাউন্ডেশন করোনা মহামারিতে ত্রাণ সহায়তা দিয়েছে ১৬২২টি পরিবারকে। প্রদান করা হয়েছে করোনার হাত থেকে বাঁচার জন্য সুরক্ষা সামগ্রী। এছাড়া বর্তমানে এই ফাউন্ডেশন স্বাস্থ্যবিষয়ক সচেতনতা প্রদান করে চলেছে। অরাজনৈতিক ও অভালজনক এই সংগঠনের কার্যক্রম হচ্ছে মেধাবী ও গরিব শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান, সমবায়ের ওপর বিশেষ গবেষণা কাজে উদ্যোগীদের উৎসাহিত করা, কারিগরি শিক্ষা তহবিল প্রদান, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কাজে সহযোগিতা, সমবায়ে বিশেষ অবদানের জন্য উৎসাহিত করা ও নানা সামাজহিতৈষী কাজে নানাভাবে অবদান রাখা। ১৪ নভেম্বর তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে তার প্রতি জানাই শ্রদ্ধাঞ্জলী।