বেপরোয়া কিশোর গ্যাংয়ের শেষ কোথায়?

বিগত কয়েক বছর ধরে রাজধানীরসহ সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে এলাকা কেন্দ্রিক গড়ে উঠছে কিশোরদের বিভিন্ন গ্রুপ। সংঘবদ্ধ হয়ে এই গ্রুপগুলো ঘটিয়ে যাচ্ছে একের পর এক অপকর্ম। শুরুতে এই গ্রুপগুলো এলাকায় নিজেদের পরিচিত করতে আধিপত্য বিস্তার করলেও আস্তে আস্তে জড়িয়ে পড়ে খুন, চাঁদাাবজি, ধর্ষণ, মাদক ব্যবসার মত নানা অপরাধে। হয়ে ওঠে নামে বেনামে এক একটি কিশোর গ্যাং। পাড়া প্রতিবেশির কাছে এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম।

বেপরোয়া কিশোর গ্যাংয়ের শেষ কোথায়?

বিগত কয়েক বছর ধরে রাজধানীরসহ সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে এলাকা কেন্দ্রিক গড়ে উঠছে কিশোরদের বিভিন্ন গ্রুপ। সংঘবদ্ধ হয়ে এই গ্রুপগুলো ঘটিয়ে যাচ্ছে একের পর এক অপকর্ম। শুরুতে এই গ্রুপগুলো এলাকায় নিজেদের পরিচিত করতে আধিপত্য বিস্তার করলেও আস্তে আস্তে জড়িয়ে পড়ে খুন, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, মাদক ব্যবসার মত নানা অপরাধে। হয়ে ওঠে নামে বেনামে এক একটি কিশোর গ্যাং। পাড়া প্রতিবেশীর কাছে এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম এখন কিশোর গ্যং।

দীর্ঘদিন ধরে সরকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সামাজিকভাবে নানা উদ্যোগ নেওয়ার কারণে এদের দৌরাত্ম্যে কিছুটা কমলেও কোনভাবেই দমানো যাচ্ছে না উঠতি বয়সী এই কিশোরদের কর্মকাণ্ড।

এই যে গতকালও পবিত্র শবে বরাতের রাতে রাজধানীর পুরান ঢাকার সূত্রাপুরের লালকুঠি এলাকায় অনন্ত (১৭) নামে এক কিশোর গ্যাং সদস্যকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করেছে অপর এক কিশোর গ্যাং। দুই গ্যাংয়ের মধ্যে বেশ কয়েকদিন ধরে সিনিয়র জুনিয়রের মত তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দ্বন্দ চলে আসছিল। এঘটনায়ই বলি হলো ১৭ বছরের একটি তরতাজা প্রাণ।

দেশব্যাপী কিশোর গ্যাং যে কত ভয়াবহ ও বিপদজনক হয়ে উঠছে তার উদাহরণ পাওয়া যায় সম্প্রতি পুলিশের আইজি বেনজীর আহমেদের বক্তব্যে। গত ১১ জানুয়ারি র‌্যাব সদর দপ্তরে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘পুলিশের জন্য এই কিশোর গ্যাং বা কিশোর অপরাধীরাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এখন।’ তিনি আরও বলেন, ‘পিতামাতা সন্তান জন্ম দিয়েছেন, তার দায়-দায়িত্বও আপনাকে নিতে হবে৷ দায়-দায়িত্ব যদি নিতে না পারেন, তাহলে সন্তান জন্ম দিয়েছেন কেন?’ পরিবারকেই কিশোর অপরাধ প্রতিরোধে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে বলে মনে করেন বেনজীর আহমেদ।

ডিএমপির অপরাধ পর্যালোচনার তথ্য অনুযায়ী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ৪০টির মতো কিশোর গ্যাং রয়েছে৷ প্রত্যেকটি গ্যাং- এর সদস্য সংখ্যা ১৫-২০ জন৷ পুলিশ সূত্র জানায়, গত এক বছরে ঢাকায় অন্তত ছয়টি হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তারা৷ এর মধ্যে উত্তরার কিশোর গ্যাং সবচেয়ে আলোচিত৷ সেখানে একাধিক গ্যাং রয়েছে৷ ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে উত্তরায় ডিসকো এবং নাইন স্টার গ্রুপের দ্বন্দ্বে নিহত হয় কিশোর আদনান কবির৷ তার পরের মাসে তেজকুনি পাড়ায় দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বে খুন হয় কিশোর আজিজুল হক৷

ঢাকার বাইরে থেকেও প্রায়ই কিশোর গ্যাং-এর দ্বন্দ্বে খুন-খারাবির খবর পাওয়া যায়৷ বরগুনার নয়ন বন্ড তার ০০৭ গ্রুপ নিয়ে জনসম্মুখে রিফাত শরিফকে কুপিয়ে হত্যা করে মেয়ে ঘঠিত কারণে৷ যে ঘটনা সারাদেশে বেশ আলোচনার জন্ম দেয়। এ হত্যার জন্যে ১১ কিশোরকে কারাদণ্ড দিয়ে বরগুনার আদালত বলেছেন, ‘সারাদেশে কিশোর অপরাধ বেড়ে যাচ্ছে৷ গডফাদাররা এই কিশোরদের ব্যবহার করছে৷’

গত বছর সাভারে স্কুল ছাত্রী নীলা হত্যায় কিশোর গ্যাং জড়িত৷ আর ওই হত্যাকাণ্ডের মূল আসামি মিজানুর রহমান কিশোর গ্যাং লিডার৷ আর তার গডফাদার স্থানীয় এক যুবলীগ নেতা৷ একই বছরের ৯ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় দুই কিশোর গ্যাংয়ের বিরোধে নাঈম নামের এক কিশোরকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়৷ একই এলাকায় গত বছরের ১ এপ্রিল শরিফ হোসেন নামে এক যুবককে কুপিয়ে হত্যা করা হয় কিশোর গ্যাং-এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার কারণে৷

অপরাধ বিজ্ঞানীরা মনে করেন, স্থানীয় প্রভাবশালী মহল, রাজনৈতিক ব্যক্তি এসব কিশোর গ্যাং গুলোকে প্রশ্রয় দিয়ে রাখে। তারা মূলত নিজেদের অবস্থান সমুন্নত রাখা, অবৈধ ব্যবসা চালানোসহ নানা অপকর্ম করতে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে এসব কিশোর গ্যাং গুলোকে। আর এধরণের ছত্রছায়া পেয়ে সারাদেশের প্রত্যন্ত এলাকাতেও কিশোর গ্যাং সক্রিয় হয়ে উঠছে। বেপরোয়া হয়ে জড়িয়ে পড়ছে হত্যা, ধর্ষণ, মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধে।

কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের তথ্য মতে যে কিশোররা ওইসব কেন্দ্রে আছে তাদের ২০ শতাংশ হত্যা এবং ২৪ শতাংশ নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার আসামি৷ ১৪ থেকে ১৬ বছর বয়সের কিশোররাই বেশি অপরাধে জড়াচ্ছে৷ কিশোররা, চুরি, ছিনতায়ের মত অপরাধেও জড়িয়ে পড়ছে বলে কেন্দ্রের তথ্যে জানা যায়৷

গত বছরের ৩০ আগস্ট বিকেলে দুই কিশোরী চাচা সম্পর্কের দুই তরুণের সঙ্গে আশুলিয়ার গুলিয়ারচক এলাকায় বেড়াতে যায়। সেখানে ১০ থেকে ১২ জনের একটি কিশোর গ্যাং তাদের আটকে রেখে মারধর করে। গ্যাংয়ের অপর সদস্যরা দুই কিশোরীকে নির্জন স্থানে নিয়ে যায়। এর দুই ঘণ্টা পর কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা তাদের ছেড়ে দেয়। পরে তারা সবাই বাসায় চলে যান। কয়েকদিন পরেই দুই কিশোরীকে ধর্ষণের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফাঁস হলে লোকলজ্জার ভয়ে ওই কিশোরী গ্রামের বাড়ি চলে যায়।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাকের ডগায় এসব অপর্কম হলেও স্থানীয় প্রভাবশালীদের কারণে অনেক সময় ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছে এসব সন্ত্রাসীরা। রাজনৈতিক ছত্রছায়া, এলাকার কথিত বড় ভাইদের অনুচর হিসেবে সক্রিয় থাকছে এসব উঠতি বয়সি মাস্তানরা।

অন্যদিকে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও এর আশেপাশের এলাকা ঘিরে গড়ে উঠেছে ‘ডিফারেন্ট বয়েজ’ ‘তূর্য গ্যাং’ ‘রিমু গ্যাং’ ‘রিয়াদবিডি ০০৭’ নামে অন্তত চারটি কিশোর গ্যাং বাহিনী। যাদের নিয়ন্ত্রণ করে স্থানীয় ডিশ ও ইন্টারনেট ক্যাবল ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতারা। আর এদের ছত্রছায়া এসব গ্যাং গুলো আধিপত্ত্ব বিস্তারে নিজেদের মধ্যে মারামারি, মাদক ব্যবসা ও চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্ম করে বেড়ায়।

পুলিশের সাবেক আইজি এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য নূর মোহাম্মদ গণমাধ্যমকে জানান, তারা এই বিষয়টি নিয়ে কমিটিতেও আলাপ করেছেন। পরিস্থিতি যে ভয়াবহ তাতে কোনো সন্দেহ নাই৷ তবে তিনি মনে করেন, ‘এখানে পুলিশ সব কিছু করতে পারবে না৷ পরিবার ও সমাজকে দায়িত্ব নিতে হবে৷ আর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রগুলোরও দায়িত্ব আছে৷ প্রত্যেক থানায় সমাজসেবা অধিদপ্তরের একজন করে কারেকশন অফিসার আছেন তারাও দায়িত্ব পালন করেন না৷’

পুলিশের আইজিপি বেনজীর আহমেদ গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রে ১৮ বছরের নিচে বয়স হলে শিশু বিবেচনা করা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন৷ নূর মোহাম্মদও মনে করেন, মানসিক বয়সও বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন৷ কারণ পুরোপুরি পরিকল্পনা করে ফৌজদারী অপরাধ করার সক্ষমতা যার আছে তার সাধারণ বয়স ১৮-এর নিচে হলেও মানসিক বয়স বেশি ৷

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার চার কোটি শিশু-কিশোর৷ এরমধ্যে এক কোটি ৩০ লাখ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরর আইন ও অপরাধ বিজ্ঞানের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন মনে করেন, ‘ওই শিশুরা তো অপরাধে জড়িয়ে পড়তেই পারে ৷’

অধ্যাপক কার্জনের মতে, নিম্নবিত্ত পরিবারে যেমন বাবা -মা দুইজনই কাজে বেরিয়ে যান, তেমনি মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত পরিবারেও বাবা-মা সন্তানকে সময় দেন না৷ তারা নানা ধরনের গেম, সিনেমা দেখে, একাকিত্বের কারণে অপরাধী হয়ে ওঠে৷ আর সমাজ ও রাষ্ট্রে অপরাধ, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহারও তাদের অপরাধে প্রলুব্ধ করে৷ রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবার শিশুদের জন্য শিশুবান্ধব পরিবেশ দিতে ব্যর্থ হচ্ছে৷ তাদের মধ্যে মূল্যবোধ তৈরি করতে পারছে না৷ যার পরিণতি আমরা এখন দেখছি বলে তিনি মনে করেন৷ তবে পরিবারের নজরদারি ও মূল্যবোধ এই কিশোর অপরাধ অনেক কমিয়ে আনতে পারেন বলে মনে করেন তিনি৷