শ্রমজীবী মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা ও অধিকার সুরক্ষার আহ্বান
কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট মহামারির প্রকোপে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমজীবী মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা ও অধিকার সুরক্ষার আহ্বান জানিয়েছেন বক্তারা।
কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট মহামারির প্রকোপে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমজীবী মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা ও অধিকার সুরক্ষার আহ্বান জানিয়েছেন বক্তারা।
মহান মে দিবস ২০২১ উপলক্ষে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিল্স) এর উদ্যোগে ‘মে দিবসের চেতনা' শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা আজ ৬ মে ২০২১ এ অভিমত ব্যক্ত করেন।
বিল্স মহাসচিব ও নির্বাহী পরিচালক নজরুল ইসলাম খান বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে শ্রমজীবী মানুষ কষ্টে আছে এবং তারা তাদের পরিবার নিয়ে সঙ্কিত। তিনি বলেন, করোনার কারণে বিপুল পরিমান শ্রমজীবী মানুষ কাজ হারিয়েছে যার মধ্যে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরাই বেশি। সরকারি কর্মচারী ছাড়া বেসরকারি শ্রমিকরা অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। এমন সময়ে রাষ্ট্রের দায়িত্ব তাদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করা।
স্বাগত বক্তব্যে বিল্স যুগ্ম মহাসচিব ডা. ওয়াজেদুল ইসলাম খান বলেন, মে দিবসের চেতনা হলো আট ঘন্টা শ্রম, আট ঘন্টা বিনোদন এবং আট ঘন্টা বিশ্রাম কিন্তু মে দিবসের ১৩৫ বছরেও শ্রমিকদের এসব অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। শ্রমিকদের ন্যূনতম অধিকার ও সামাজিক সুরক্ষা নেই উল্লেখ করে তিনি শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। এসময় তিনি শ্রমিকদের জন্য রেশনিং ব্যবস্থা এবং চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার দাবি জানান।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক মোঃ নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেন গত বছরের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট কমিটি এ বছর নতুন অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করে বিদ্যমান সমস্যা মোকাবেলায় কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তিনি বলেন, শ্রমজীবী মানুষরা যেন কম মূল্যে খাদ্য পেতে পারেন তার জন্য টিসিবিকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে যাতে করে শ্রমঘন এলাকায় টিসিবি তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করেন। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের হেল্প লাইনে আসা শ্রমিকদের অভিযোগগুলো তাৎক্ষনিক সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি শ্রমিকদের সমস্যা সমাধানে সবাইকে একসাথে কাজ করার আহ্বান জানান।
করোনার কারণে দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত উল্লেখ করে শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ (স্কপ) এর যুগ্ম সমন্বয়কারী এবং জাতীয় শ্রমিক লীগের সভাপতি নূর কুতুব আলম মান্নান আলোচনাসভা থেকে উঠে আসা সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে মাঠ পর্যায়ের ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে যাবার আহ্বান জানান।
আইএলও সাউথ এশিয়ার ডিসেন্ট ওয়ার্ক টেকনিক্যাল টিমের ওয়ার্কার্স অ্যাক্টিভিটিস সুলতান উদ্দিন আহম্মদ বলেন, মহান মে দিবসের আন্দোলন হয়েছিল আট ঘন্টা কর্মঘন্টার দাবিতে কিন্তু লকডাউনে সরকার যেখানে কর্মঘন্টা কমানোর কথা সেখানে গার্মেন্টস শ্রমিকদের নির্দিষ্ট কর্মঘন্টা থেকে অব্যাহতি দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। আইনের বিধান হচ্ছে জনগুরুত্বপূর্ণ হলে অব্যাহতি দেয়া যাবে। এ বিষয়টি আরো স্পষ্ট হওয়া দরকার।
আইএলও’র এসডি এন্ড আইআর প্রজেক্টের চিফ টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার নিরান রামযুথান বর্তমান কোভিড-১৯ শ্রমিকের র্কমসংস্থান, জীবন জীবিকাসহ শিক্ষার উপর মারাত্বক প্রভাব পড়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে শ্রমিকদের বীমা সুবিধা, ক্ষতিপূরণ ও সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য কার্যকরী সামাজিক সংলাপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
শ্রমিকরা করোনা ভীতি উপেক্ষা করে কাজ করলেও মালিকরা তাদের মজুরি দিতে বিলম্ব করে উল্লেখ করে শ্রম অধিদপ্তরের পরিচালক গিয়াসউদ্দিন আহমেদ বলেন, বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে শ্রমিকরা যেন চাকরি না হারায় এবং বেতন বোনাস যেন ঠিকমত পায় সেজন্য সরকার কাজ করে যাচ্ছে। তিনি শ্রমিকদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার জন্য মালিকদের প্রতি আহ্বান জানান।
সভায় করোনাকালে শ্রমিকের সামাজিক নিরাপত্তা ও অধিকার সুরক্ষা বিষয়ক উপস্থাপনায় বিল্স গবেষণা বিভাগের উপ-পরিচালক মোঃ মনিরুল ইসলাম বলেন, আইএলওর তথ্য অনুযায়ী কোভিড-১৯ এর কারণে ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে জুন সময়কালে বৈশ্বিক কর্মঘন্টা কমেছে প্রায় সাড়ে ১০ শতাংশ। বিশ্বের প্রায় ৩০৫ মিলিয়ন মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বাংলাদেশের মোট শ্রম শক্তির প্রায় ৩ শতাংশ শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। তিনি উল্লেখ করেন মার্চ-সেপ্টেম্বর ২০২০ এর মধ্যে প্রায় ০.৪ মিলিয়ন অভিবাসী শ্রমিক চাকুরি হারান। এসময় ২.৪৫ কোটি নতুন দ্রারিদ্রের সৃষ্টি হয়।
তাছাড়া শ্রমিকদের জন্য নির্দিষ্ট কোন ডাটাবেস না থাকায় কি পরিমান শ্রমিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তা নির্ণয় করা কঠিন বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি আরো বলেন, শ্রমিকদের জন্য সামাজিক সুরক্ষার যথেষ্ট ঘাটতি থাকায় শ্রমিকদের অসহায়ত্ব অনেকাংশেই বেড়েছে। শ্রমিকের করোনার প্রভাব মোকাবেলায় মালিক-শ্রমিক, বায়ার এবং দাতা সংস্থার সমন্বয়ে উচ্চ পর্যায়ের জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করা জরুরি। তাছাড়া যথাযথ সামাজিক সংলাপ এবং শ্রমিকদের জন্য জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা এখন সময়ের দাবি বলে তিনি উল্লেখ করেন।
সভাপতির বক্তব্যে বিল্স ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসাইন বলেন, শ্রমিকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে তাই তাদেরকের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভ্যাকসিন প্রদান করতে হবে। ভ্যাকসিন নিয়ে শ্রমিকদের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধিতে ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
বিল্স উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য নইমুল আহসান জুয়েল এর সঞ্চালনায় সভায় আরো বক্তব্য রাখেন জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি কামরূল আহসান, ট্রেড ইউনিয়ন সংঘের সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী আশিকুল আলম, জাতীয় শ্রমিক জোট বাংলাদেশের সভাপতি সাইফুজ্জামান বাদশা, বাংলাদেশ লেবার ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক সাকিল আখতার চৌধূরী প্রমুখ। এছাড়া জাতীয় ট্রেড ইফনিয়ন ফেডারেশন নেতৃবৃন্দ সভায় উপস্থিত ছিলেন।