চলছে দুদকের তদন্ত, থেমে নেই শামীম

সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের অনুজদের দূর্নীতির প্রশিক্ষক হিসাবে কাজ করছেন নির্বাহী প্রকৌশলী শামীমুল হক। দূর্নীতির পুরষ্কার হিসেবে পটুয়াখালির ফেরি বিভাগ থেকে বদলি হয়ে এসেছেন সওজের ঢাকা অফিসের সংগ্রহ ও সংরক্ষণ বিভাগে। ঢাকা অফিসে যোগদানের পর অনিয়মের আতুরঘরে পরিণত করেন সংগ্রহ ও সংরক্ষণ বিভাগের সকল শাখা অফিসকে। তার এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন অনুসন্ধান শুরু করেছে। বিভাগীয় তদন্তের নামে প্রহসন চলছে বলে সংশ্লিষ্ট অনেকেই অভিযোগ করেন। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরে কর্মজীবনের শুরু থেকেই দূর্নীতির প্রশিক্ষক হয়ে উঠেন এক সময়ের শিক্ষকতা করা শামীমুল হক।

চলছে দুদকের তদন্ত, থেমে নেই শামীম

সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর

সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের অনুজদের দূর্নীতির প্রশিক্ষক হিসাবে কাজ করছেন নির্বাহী প্রকৌশলী শামীমুল হক। দূর্নীতির পুরষ্কার হিসেবে পটুয়াখালির ফেরি বিভাগ থেকে বদলি হয়ে এসেছেন সওজের ঢাকা অফিসের সংগ্রহ ও সংরক্ষণ বিভাগে। ঢাকা অফিসে যোগদানের পর অনিয়মের আতুরঘরে পরিণত করেন সংগ্রহ ও সংরক্ষণ বিভাগের সকল শাখা অফিসকে। তার এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন অনুসন্ধান শুরু করেছে। বিভাগীয় তদন্তের নামে প্রহসন চলছে বলে সংশ্লিষ্ট অনেকেই অভিযোগ করেন। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরে কর্মজীবনের শুরু থেকেই দূর্নীতির প্রশিক্ষক হয়ে উঠেন এক সময়ের শিক্ষকতা করা শামীমুল হক।

পটুয়াখালী ফেরি বিভাগে কর্মরত থাকার সময়কালে ফেরির যন্ত্রাংশ সংস্কার ও উন্নয়নের নামে অতিরিক্ত বিল উত্তোলন, ফেরি ঘাট ইজারাদার হতে সাপ্তাহিক ভিত্তিতে অর্থ আদায়, ফেরির জ্বালানী তেল ও লুব্রিকেন্ট অয়েল ক্রয়ের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত বিল করাসহ একাধিক অভিযোগ ছিল এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। এত অনিয়মের পরেও বিভাগীয় তদন্তকে পাশ কাটিয়ে দুর্নীতির পুরষ্কার হিসাবে বদলি হয়ে এসেছেন সওজের ঢাকা অফিসের সংগ্রহ ও সংরক্ষণ বিভাগে। ঢাকায় বদলি হয়ে এসেও থেমে নেই নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শামীমুল হকের দৌরাত্ন।

একাধিক সিন্ডিকেটের সদস্য হয়ে ইতিমধ্যে নিজ অবস্থান দৃঢ় করার পাশাপাশি অনুজদের মাঝে দূর্নীতির প্রশিক্ষক হিসেবে এখন বেশ জনপ্রিয় নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শামীমুল হক। যে কোন বদলি অথবা পুনরায় বদলি (সাবেক কর্মস্থলে ফিরিয়ে আনা), টেন্ডার বাণিজ্যসহ সর্বক্ষেত্রেই ততবির করার ক্ষমতা রাখেন মো. শামীমুল হক। আজকের সংবাদের হাতে আশা সওজের কয়েটি বদলি আদেশ লক্ষ্য করলে তার প্রামাণ পাওয়া যায়। ২০২১ নভেম্বর মাসের ২ ও ৯ তারিখে সাবেক প্রধান প্রকৌশলী আবদুস সবুর স্বাক্ষরিত বদলি আদেশে সওজের একাধিক উপসহকারী প্রকৌশলীকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের অফিসে বদলি করা হয়। আর মাস পরিবর্তন হওয়ার আগেই বদলি আদেশ পরিবর্তন করে ২১ নভেম্বর পুনরায় ৪জন উপসহকারী প্রকৌশলীকে সাবেক কর্মস্থলে ফিরিয়ে আনা। এসব ততবিরের মূল হোতা তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো.আমানুল্লাহ এর আস্থাভাজন নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শামীমুল হক।

বর্তমানে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো.আমানুল্লাহ ও অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলামের ক্যাশিয়ার ম্যান হিসাবেও নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শামীমুল হক কাজ করছেন বলে জানায় সে সময় শূণ্য পদে পটুয়াখালীতে বদলি হয়ে যাওয়া একজন উপ-সহকারী প্রকৌশলী। তিনি আজকের সংবাদ’কে একটি প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ২০২১ সালে পটুয়াখালী ফেরি বিভাগের শূন্য পদে বদলী হলে সাবেক কর্মস্থলে বদলি হতে চাই কি না এ বিষয়ে জানতে চান নির্বাহী প্রকৌশলী শামীমুল হক। তিনি আমাকে বলেন, বদলির জন্য ১৮ লক্ষ থেকে ২০ লক্ষ টাকা খরচ করতে হবে।

আজকের সংবাদের হাতে আসা সওজের বদলির আদেশে নজর দিতে লক্ষ্য করা যায় যে, ২০২১ নভেম্বর মাসের ২ ও ৯ তারিখে বদলি আদেশ পাওয়া যান্ত্রিক বিভাগের চার উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. আকশ আলী, মো. হাবিবুর রহমান, মোহাম্মদ রায়হান ও মো. সাইদুল ইসলামকে ২১ নভেম্বর পুনরায় বদলি করে আনা হয়েছে তাদের সাবেক কর্মস্থলে। আর যার জন্য ততবির করেছেন নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শামীমুল হক। এমন তথ্য নিশ্চিত করেছেন একাধিক উপ-প্রকৌশলী। নাম না প্রকাশের শর্তে তারা আজকের সংবাদ’কে বলেন, আমরা একটা ষড়যন্ত্র মূলক পরিবর্তনের শিকার হয়েছি। মূলত আমাদের বদলিটা অর্থ আয়ের মাধ্যম হিসাবে কাজ করেছে একাধিক সিনিয়ারের জন্য। তারা বলেন আমাদের বদলির সময় প্রায় কোটি টাকার মত অর্থ হাত বদল হয়েছে। যার ক্যাশিয়ার ম্যান হিসাবেও কাজ করছেন শামীমুল হোক স্যার।

শুধু বদলি বাণিজ্য নয়, আজকের সংবাদের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শামীমুল হকের অবৈধভাবে টেন্ডার আবেদনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট চারটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেয়ার বিষয়টি এবং পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে অনৈতিকভাবে বিপুল পরিমানের অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার বিষয়টিও।

আজকের সংবাদের অনুসন্ধানে উঠে আসা তথ্যে দেখা যায়, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) নিয়ম না মেনে নির্দিষ্ট ঠিকাদারের মাধ্যমে বেশ কিছু নিরাপত্তা সামগ্রী (সিকিউরিটি মেটেরিয়াল) ক্রয় করে অনৈতিকভাবে বিপুল পরিমান অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন তেজগাঁও সংগ্রহ ও সংরক্ষণ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শামীমুল হক ও একই দপ্তরের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. সাইদুল ইসলাম। ক্রয় সংক্রান্ত কাগজে লক্ষ্য করা যায় যে, ৫০০ টাকা মূল্যের ২০ টি আন্ডার চেকিং মিরর ক্রয় করেছেন ১০ লাখ ৮ হাজার টাকায়। অর্থাৎ ২০ টি চেকিং মিররের প্রকৃত বাজার মূল্য মাত্র ১০ হাজার টাকা হলেও কিনেছে ১০০ গুণ বেশি দামে। ঢাকার বিভিন্ন মার্কেটে ঘুরে দেখা গেছে, এসব যন্ত্রাংশ বাজারমূল্যের চেয়ে ২ থেকে ২০ গুণ দামে কেনা হয়েছে। সড়ক ও জনপথ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বিষয়টি নিয়ে বিভাগীয় তদন্ত শুরু হলেও অজানা কারণে বর্তমানে তার কোন অগ্রগতি নেই।

অনুসন্ধানে আরও উঠে এসেছে, অবৈধভাবে টেন্ডার আবেদনের মাধ্যমে প্রকৌশলী মো. শামীমুল হক তার নির্দিষ্ট চারটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দিয়েছেন একাধিকবার। ক্রয়কৃত পণ্যের মূল্য বেশি দেখিয়ে বিপুল পরিমান অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। যার লিখিত প্রমাণ আজকের সাংবাদের হাতে এসেছে। প্রাপ্ততথ্য মতে, গত ২০২১ সালের ১০ মে’ চারটি টেন্ডারের মাধ্যমে ব্যাপক অনিয়ম ও বিপুল পরিমান অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন সওজ এর প্রকৌশলী মো. শামীমুল হক ও উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. সাইদুল ইসলাম। টেন্ডার নাম্বারগুলো হলো- ৪৪৯০৮১, ৪৪৯০৮২, ৪৪৯০৮৩, ৪৪৯০৮৪। অর্থনৈতিক কোড নং- ৪১২১১০১।

আজকের সংবাদের হাতে আসা তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মাত্র প্রায় ১৫০ টাকার একেকটি ট্রাফিক বাটনের বাজার মূল্য দেখানো হয় ৭ হাজার টাকা। অর্থাৎ ২০ টি রির্চারজেবল ট্রাফিক বাটন ক্রয় হয়েছে এক লাখ ৪০ হাজার টাকায়। ৫০০ টাকা মূল্যর ২০ টি আন্ডার চেকিং মিরর ক্রয় মূল্য দেখানো হয় ১০ লাখ ৮ হাজার টাকা। অর্থাৎ ২০ টি চেকিং মিররের প্রকৃত বাজার মূল্য মাত্র ১০ হাজার টাকা। ডাবল হুকের ২২ টি সেফটি বেল এর মূল্য দেখানো হয় ছয় লাখ ১৬ হাজার টাকা। যদিও প্রতিটি ডাবল হুকের প্রকৃত বাজার মূল্য দেড় হাজার টাকা। ৩ হাজার ৬০০ টাকা মূল্যর ১০ কয়িল নেটওয়ার্ক কেবলের মূল্য ধরা হয়েছে ছয় লাখ ৯৭ হাজার টাকা। যার প্রকৃত বাজার মূল্য মাত্র ৩৬ হাজার টাকা। ৪০০ টাকা মূল্যের সেফটি হেলমেট ক্রয় করা হয়েছে ৩৬ হাজার টাকায়। যদিও প্রতিটি হেলমেটের বাজার মূল্য ৪০০ টাকা।

দুইটি এনভিআর (নেটওর্য়াক ভিডিও রেকর্ডার) ক্রয় মূল্য দেখানো হয় এক লাখ ৬৪ হাজার টাকা। যার প্রকৃত বাজার মূল্য ১২ থেকে সর্বোচ্চ ১৬ হাজার টাকা। ১৪ হাজার টাকার ২টি ৪টিবি স্টোরেজ হার্ড ডিস্ক ক্রয় মূল্য দেখানো হয় ১ লাখ ৬৬ হাজার টাকা। চার পোর্টের দুইটি সুইচের ক্রয় মূল্য দেখানো হয় এক লাখ ২৪ হাজার টাকা। যার প্রকৃত বাজার মূল্য ছয় থেকে আট হাজার টাকা। আট পোর্টের দুইটি সুইচের ক্রয় মূল্য দেখানো হয় এক লাখ ২৪ হাজার টাকায়। যার প্রকৃত বাজার মূল্য সাত থেকে দশ হাজার টাকা। ১৫ কয়িল নেটওর্য়াক কেবলের ক্রয় মূল্য দেখানো হয় ৯ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। প্রতি কয়িল কেবলের প্রকৃত বাজার মূল্য চার হাজার টাকা। ২৭ ইঞ্চি দুইটি এলইডি মনিটরের ক্রয় মূল্য দেখানো হয় ১ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। যার একটির বাজার মূল্য আট হাজার টাকা। ৫ হাজার টাকা মূল্যর একটি টু হোয়েল ট্রলির ক্রয় মুল্য দেখানো হয় ২৭ হাজার ৯৯ টাকা। তিন হাজার টাকা মূল্যের ৪৩টি স্ক্যানারের ক্রয় মূল্য দেখানো হয় সাত লাখ ৭৪ হাজার টাকা। আরো বেশ কিছু পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে একই ভাবে অতিরিক্ত বিল দেখিয়ে অর্থ আত্মসাত করেছেন নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শামীমুল হক। আজকের সংবাদের হাতে আসা তথ্য বলছে, ২০২১ সালে এক কোটি টাকার একটি টেন্ডার হতে প্রায় ৮৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন সওজ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শামীমুল হক ও তার সিন্ডিকেট। তার এসব অনিয়মের কারণে দুর্নীতির দমন কমিশন তদন্তে নেমেছে। ঠিকাদাররা অভিযোগ করে বলেন, দুদক ম্যানেজ করার জন্য মোটা অংকের টাকা নিয়ে উঠেপড়ে লেগেছেন শামীম।

উল্লেখ্য, কেবল যন্ত্রাংশ ক্রয়ের জন্য প্রতিবছর প্রায় ৯ কোটি টাকারও বেশি অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয় সড়ক ও জনপথ বিভাগে। প্রকৌশলী শামীমুল হক ও তার সিন্ডিকেট অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে এখানের প্রায় ৯০ শতাংশ কাজ করায় চারটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে আসছে। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলো হলো, জননী ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, মেসার্স আশা এন্টারপ্রাইস, মিলন অ্যান্ড বাদ্রার্স, ইকন ইঞ্জিনিয়ারিং। ক্ষমতার অপব্যবহার করে নানাভাবে হুমকি দেখিয়ে এই নির্দিষ্ট চার ঠিকাদারের ভয়ে সাধারণ ঠিকাদারদের টেন্ডার দাখিলেরও সুযোগ দেওয়া হয় না।

সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী এ কে এম মনির হোসেন পাঠানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি মুঠোফোনে খুদে বার্তার মাধ্যমে ঢাকা জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. সবুজ উদ্দিন খানের সাথে যোগাযোগ করতে বলেন। ঢাকা জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. সবুজ উদ্দিন খানের কাছে নির্বাহী প্রকৌশলী শামীমুল হকের দূর্নীতির বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি আজকের সংবাদ’কে বলেন, আমাদের বদলি নিয়ম অনুসারে হয়েছে। এখানে কোনো অনিয়মের সুযোগ নেই। ক্রয় সংক্রান্ত বিষয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এ বিষয়ে বিভাগীয় তদন্ত হচ্ছে। তদন্ত শেষ হলে সঠিক উত্তর দেওয়া যাবে।